DoinikAstha Epaper Version
ঢাকাশুক্রবার ৩রা মে ২০২৪
ঢাকাশুক্রবার ৩রা মে ২০২৪

আজকের সর্বশেষ সবখবর

আলাউদ্দিন হোসেন শাহকে পরপর চারবার পরাজিত করে

Abdullah
এপ্রিল ২৬, ২০২৩ ১১:০৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

আলাউদ্দিন হোসেন শাহকে পরপর চারবার পরাজিত করে

 

মোফাজ্জল হোসেন ইলিয়াছঃ

 

‘ত্রিপুরা’ বাংলাদেশের একটি অন্যতম জাতি। ত্রিপুরা জাতি ৩৬টি গোত্রে বিভক্ত। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এ জাতির বসবাস দেখা যায়। বাংলাদেশের খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, ফরিদপুর, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।

 

ভারতের ‘ত্রিপুরা’ ও ‘মিজোরাম’ রাজ্যে ত্রিপুরাদের বসতি রয়েছে। বার্মাতেও ত্রিপুরাদের বসতি আছে বলে জানা যায়। এ জাতির ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ। ‘ত্রিপুরাব্দ’ নামে এ জাতির নিজস্ব এক অব্দও প্রচলিত আছে যা বঙ্গাব্দ থেকে ৩ বছরের প্রাচীন।

 

ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি:-জাতি হিসেবে ‘ত্রিপুরা’ নামের উৎপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি মতবাদের প্রচলন আছে। অনেকে বলেন, ‘তোয়প্রা’ থেকে ত্রিপুরা নামের উৎপত্তি। ‘তোয়’ মানে পানি বা নদী আর ‘প্রা’ মানে সঙ্গমস্থল বা মোহনা। ধারণা করা হয় যে, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী নদীর মোহনায় এক সময় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা বসবাস করেছিল এবং রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল।এই তিন নদীর মোহনা বা ‘তোয়প্রা’ শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে পরবর্তীতে ‘ত্রিপুরা’ নামটি জাতির নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।

 

ত্রিপুরা রাজণ্যবর্গের ইতিহাসগ্রন্থ ‘রাজমালা’তে ও এর উল্লেখ আছে। মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের সমসাময়িক রাজমালা গ্রন্থের লেখক কৈলাস চন্দ্র সিংহ-এর মতে, ত্রিপুরা নামের সাথে ককবরক ভাষার দুটি শব্দ জড়িত রয়েছে। শব্দ দুটি হল তোয় ও প্রা। ককবরক ভাষায় ‘তোয়’ অর্থ পানি আর ‘প্রা’ অর্থ মোহনা বা নিকটে। তাঁর মতে কোন এক সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমানা সমুদ্র সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেজন্য এই রাজ্যের নাম ‘ত্রিপুরা’ হয়েছে। রাজ্যের নামানুসারে পরবর্তীতে জনগোষ্ঠীর নাম হয় ‘ত্রিপুরা’।

 

ঐতিহাসিক পটভূমিকা:-ত্রিপুরা মহারাজারা প্রাচীনকালে ‘ফা’ উপাধি গ্রহণ করতেন। রত্নফার আমল থেকে ত্রিপুরা মহারাজারা ‘মানিক্য’ উপাধি ধারণ করেন। মহারাজ হামতর ফা বীররাজ ৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসন আরোহণ করেন। হামতরফা অতিশয় শক্তিশালী ও প্রজাবৎসল রাজা ছিলেন। এই মহারাজার রাজত্বকালে প্রথম চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে জনবসতি গড়ে উঠে ও আবাদ করা হয় বলে জানা যায়।

 

এ বিষয়ে চিটাগাং ডিষ্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার-এ উল্লেখ আছে – ‘ King Bira Raja of Tippera (Tripura) was the founder of Chittagong Hill Tracts in 590.’ তিনি ৫৯০ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গদেশ জয় করেন এবং শেষার্ধে আরাকান রাজ্য জয় করে ত্রিপুরার সীমানা সম্প্রসারিত করেন।পিতার জীবদ্দশায় ৬৯২ ত্রিপুরাব্দে বা ১২৮২ খ্রীষ্টাব্দে মহারাজা রত্নফা সিংহাসন আরোহণ করেন। রত্নফাই প্রথম ত্রিপুরা রাজা যিনি ‘মানিক্য’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।

 

রত্নফা মৃগয়ায় গিয়ে গোমতী নদীর উজানে ৩টি মহামূল্য মানিক্য রত্ন কুড়ে পেয়েছিলেন বলে মানিক্য উপাধিতে ভূষিত হন। রত্ন মানিক্যই প্রথম ত্রিপুরা রাজা যিনি ত্রিপুরা রাজ্যের মধ্যে মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। রত্ন মানিক্য অতিশয় মানবতাবাদী ছিলেন। তিনি তাঁর আমলে আশ্রয়প্রার্থী ১০ হাজার বাঙ্গালিকে ত্রিপুরা রাজ্যে পুনর্বাসিত করেছিলেন। পিতা রত্ন মানিক্য এরপর ধর্ম মানিক্য এবং পরে তার পুত্র ধন্য মানিক্য সিংহাসনে বসেন। ধন্য মানিক্য সেনাপতি রায় কাচাগকে দিয়ে কুকি রাজ্য ও আরাকান প্রদেশ দখল করে ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত করেন।

 

ধন্য মানিক্য বঙ্গদেশ জয় করেন এবং যুদ্ধে আলাউদ্দিন হোসেন শাহকে পর পর চার বার পরাজিত করেন।মহারাজা ধন্য মানিক্য দু’বার চট্টগ্রাম অধিকার করেন। প্রথমবার ১৫১৩ খ্রীষ্টাব্দে এবং দ্বিতীয়বার ১৫১৫ খ্রীষ্টাব্দে। তিনি ১৫১৫ খ্রীষ্টাব্দে পর্তুগীজ, পাঠান ও আরাকান এই ত্রিশক্তিকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করে চট্টগ্রামকে ত্রিপুরা রাজ্যভুক্ত করেন। তিনি মহাভারত গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করিয়েছিলেন। মহারাজা ধন্য মানিক্য সীতাকুন্ডু তীর্থের প্রবর্তক এবং শম্ভুনাথ মন্দিরের নির্মাতা।

 

এরপর মহারাজা বিজয় মানিক্য, অমর মানিক্য, পিতা রাজধর মানিক্যের মৃত্যু হলে যশোধর মানিক্য ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিপুরার সিংহাসনে আরোহণ করেন। মহারাজা যশোধর মানিক্যের সাথে মোঘল সম্রাটের যুদ্ধ বাঁধে। এ যুদ্ধে যশোধর মানিক্য পরাজিত হয়। যশোধর মানিক্যের পর কল্যাণ মানিক্য ১৬২৬ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিপুরার সিংহাসন আরোহণ করেন। তিনি বাংলার নবাব সুজাউদৌল্লার সাথে এক ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হন। এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় কুমিল্লার কসবা অঞ্চলে। এ যুদ্ধে নবাব সুজাউদৌল্লাহ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।

 

পিতা কল্যাণ মানিক্যের মৃত্যু হলে মহারাজা গোবিন্দ মানিক্য ত্রিপুরার সিংহাসন আরোহণ করেন ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দে। তিনি ভাইয়ে ভাইয়ে হানাহানি থেকে মুক্তি লাভের জন্য স্বেচ্ছায় রিয়াং অঞ্চল বর্তমান দীঘিনালায় নির্বাসন জীবনযাপন করেন। সে সময় এক দীঘি খনন করেন। সেই থেকে রিয়াং অধ্যুষিত এই এলাকার নাম হয় ‘দীঘিনালা’। গোবিন্দ মানিক্য বন্ধুর নির্দশনস্বরূপ কুমিল্লা নগরীতে ‘শাহ সুজা মসজিদ’ নামে এক উৎকৃষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন।

 

মহারাজা কৃষ্ণ কিশোর মানিক্য ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে ত্রিপুরার সিংহাসন আরোহণ করেন। মীর কাশিম ত্রিপুরা রাজাকে পরাস্ত করার জন্য বৃটিশের শরণাপন্ন হন। বৃটিশ এটিকে উপযুক্ত সময় মনে করে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বৃটিশ চাকলা রোশনাবাদ, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে পুরোপুরি অধিকার করার প্রবৃত্ত হয়। ফলত বৃটিশের সাথে মহারাজা কৃষ্ণ কিশোর মানিক্যের মধ্যে যু্দ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মহারাজা কৃষ্ণ কিশোর মানিক্য পরাজিত হয় এবং বৃটিশের সাথে এক সন্ধিতে উপনীত হতে বাধ্য হয়।

 

এরপর বীরচন্দ্র মানিক্য, রাধা কিশোর মানিক্য ত্রিপুরা রাজ্য শাসন করেন। মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য জগদ্বীশ চন্দ্র বসুর বিজ্ঞান গবেষণা, রবীন্দ্রনাথের শান্তি নিকেতন ইত্যাদি মহৎ কাজে অকাতরে অর্থ দান করেছিলেন। স্বাধীন ত্রিপুরার সর্বশেষ রাজার অকাল মুত্যুতে জ্যেষ্ঠ পুত্র নাবালক বিধায় মহারাণী কাঞ্চন প্রভা ত্রিপুরার সিংহাসনে আরোহণ করেন। ত্রিপুরা রাজ্যে শক্তিশালী শাসকের অভাবের কারণে অবশেষে ১৯৪৯ সালে এক চুক্তির মধ্য দিয়ে ‘ত্রিপুরা রাজ্য’ ভারত ইউনিয়নে যোগ দিতে বাধ্য হয়। এই চুক্তির মধ্যদিয়ে ১৫০০ বছরের গৌরবময় ত্রিপুরা জাতির সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলো। অতঃপর ত্রিপুরা জাতি পরিণত হলো এক পরাধীন জাতিতে।

 

সামাজিক সংগঠন ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা:-
ত্রিপুরা সমাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। পিতাই পরিবারের প্রধান এবং পিতার পরিচয়ে সাধারণত সন্তানদের বংশ পরিচয় নির্ধারিত হয়। অবশ্য ত্রিপুরাদের কোন কোন গোত্রে মেয়ে সন্তানেরা মায়ের বংশ পরিচয়ে পরিচিত হয়। যেমন: ফাদুঙ, দেনদাউ, গাবিং ইত্যাদি গোত্রে মেয়ে সন্তানরা মায়ের বংশ পরিচয়ে পরিচিত হন। ত্রিপুরা জাতি ৩৬ দফা বা গোত্রে বিভক্ত।

 

জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ:-ত্রিপুরা সমাজে শিশু জন্ম হলে জন্মের পর পর গুমাচক(দাত্রী), অচাই(পৌরহিত) মিলে ছড়া বা নদীতে যেয়ে পূজা দিতে হয়। এ পূজাকে বলা হয়  ‘কউমা বৌতৈ লানাই’। হলুদ, সুকই বমলক ও পানি মিশিয়ে ‘কউমা বৌতৈ’ তৈরি করতে হয়। সেই ‘কউমা বৌতৈ’ বাঁশের চোঙায় করে বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। পূজা দেওয়ার পর সেই বাঁশের চোঙার কউমা বৌতৈ-এর সাথে পূজায় বলি দেওয়া মুরগির রক্ত মিশাতে হয়।

 

গুমাচৌকসহ যে সব নারী-পুরুষ সন্তান প্রসবের সাথে সম্পৃক্ত ছিল তাদের সবার শরীরে ‘কউমা বৌতৈ’ ছিটিয়ে দিয়ে শুদ্ধ করতে হয়। শরীর থেকে নাভি পৃথক হবার পর আবার মুরগি কেটে নদী বা ছড়ায় গিয়ে পূজা দিতে হয়।ত্রিপুরা সমাজে শিশুর জন্মসংক্রান্ত সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হলো-‘আবিয়াক সুনায় পান্ডা’ বা নামকরণ অনুষ্ঠান। ছাগল, শূকর, মুরগি কেটে এই ‘আবিয়াক সুনায়’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

 

ত্রিপুরা সমাজব্যবস্থায় চার ধরনের বিবাহ ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। এগুলি হলো–১) হামজাক-লাই লামা, ২) খকয়ৈই লামা, ৩) ফারান খৌলায়ৈ লামা, ৪) চামিরি কামা। ত্রিপুরা সমাজে বিধবা বিবাহেরও প্রচলন আছে। ত্রিপুরা সমাজে বহু বিবাহ সিদ্ধ; তবে অতীতকাল থেকে এ রীতি সমাজে নিন্দনীয় ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত।

 

ত্রিপুরারা সাধারণত মৃতদেহকে দাহ করে। একেবারে কম বয়সী শিশু মারা গেলে বা কোন লোক দুরারোগ্য বা ছোঁয়াচে রোগ যেমন – কলেরা, বসন্ত, কুষ্ঠ ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তাকে কবর দেয়া হয়। রীতি অনুসারে মৃতব্যক্তির সন্তানরাই প্রথম চিতায় অগ্নিসংযোগ করে। মৃতব্যক্তির সন্তান না থাকলে ঘনিষ্ঠ আত্নীয়-স্বজনরা প্রথম অগ্নিসংযোগ করে। সামাজিক রীতি অনুসারে মৃতদেহ দাহ করার সাতদিন অথবা তেরদিন পর শ্রাদ্ধক্রিয়া অনুষ্ঠান সম্পাদন করতে হয়।

 

ধর্ম ও ধর্মীয় পূজা পার্বণ:-ত্রিপুরারা মূলত সনাতন (হিন্দু ধর্ম) ধর্মাবলম্বী। তবে বর্তমানে বান্দরবান জেলার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী।

 

খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলায়ও ত্রিপুরাদের একটি অংশ বর্তমানে খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী। সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর লোকেরা দূর্গাপূজা, কালী পূজা, রাজ মেলা, স্বরস্বতী পূজা ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে।

 

এছাড়াও ত্রিপুরারা বহুবিধ পূজা-পার্বণ করে থাকে। পূজা-পার্বণের মধ্যে ক) কের পূজা, খ) কাথারক পূজা, ৩) চুমুলাই পূজা, ৪) সাকচরাই, ৫) নাইরাং, ৬) খ্রাঙ পূজা, ৭) মৌতাই কাইমানি, ৮) খার্চি পূজা, ৯) গড়িয়া পূজা ইত্যাদি অন্যতম।

 

সামাজিক উৎসব:-ত্রিপুরাদের প্রধান সামাজিক উৎসবের নাম ‘বৈসু’। ত্রিপুরারা তিনদিন ধরে এই উৎসব উদযাপন করে থাকে। এগুলো হলো ১) হারি বৈসু, ২) বৈসুমা ও ৩) বিসিকাতাল। পুরনো বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বাগত জানানোকে কেন্দ্র করে এ ঐতিহ্যবাহী উৎসব উদযাপন করা হয়ে থাকে। এই তিন দিনে বিন্নি চাল দিয়ে নানান ধরনের পিঠা তৈরি করা হয়। নারী পুরুষেরা নূতন নূতন কাপড়-চোপড় পরিধান করে আনন্দে মেতে উঠে।

 

এদিনে গান বাজনা হয়, খেলাধুলা হয়। বৈসু উপলক্ষে ৫/৭ দিন গড়িয়া নৃত্য পরিবেশন করা হয়। দল বেঁধে গড়িয়া দল গ্রামে গ্রামে ঘুরে গড়িয়া নৃত্য পরিবেশন করে।বৈসুমার দিনে ধনী-গরিব সবাই সামর্থ্যনুযায়ী নানা ধরনের পিঠা, মদ, সরবত, পাঁচন ইত্যাদি অতিথিদের পরিবেশন করে। তবে ‘বৈসুমা’র দিনে প্রানীবধ একেবারেই নিষিদ্ধ। ‘বৈসুমা’র দিনে ও গড়িয়া নৃত্য পরিবেশন করা হয়। গড়িয়া নৃত্য ছাড়াও পালা গান ও বিভিন্ন খেলাধুলা সারাদিন ধরে চলে। বিসিকাতাল দিনে নববর্ষকে স্বাগত জানানো হয়।

 

এদিকে নতুন বছরে সুন্দর ও নিরাপদ জীবনের প্রত্যাশায় সমাজের সকল বয়সের মানুষ বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট আর্শীবাদ গ্রহণ করা হয়। বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতী নতুন কাপড়-চোপড় পরিধান করে গ্রামের ঘরে ঘরে হাঁস-মুরগি ও অন্যান্য পশু-পাখির খাবার বিলিয়ে দেয় এবং ত্রিপুরা সামাজিক রীতি অনুসারে বয়স্কদের পা ধরে সালাম করে আর্শীবাদ গ্রহণ করে।এদিনে পরিবারের সকল সদস্যের মঙ্গলের জন্য পূজা ও উপাসনা করা হয়।

 

সংস্কৃতি ও ভাষা-সাহিত্য:-ত্রিপুরা ভাষার নাম ‘ককবরক’। এ জনগোষ্ঠীর ভাষা ‘ককবরক’ হল সিনো-টিবেটান পরিবারের তিব্বতী-বর্মী উপ-পরিবারের ভাষা। ত্রিপুরাদের লোক-সাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। যেমন – ‘পুন্দা তান্নায়’, ‘লাংগই রাজানো বুমানি’, ‘হায়া হা সিকাম কামানি,’ ‘খুম কামানি’, ‘গাঁ তলিয়ো থাঁমানি’ ইত্যাদি সমৃদ্ধ গীতিকাব্য। এছাড়া ত্রিপুরাদের বহু রূপকথা, লোককাহিনী, ধাঁ ধাঁ, প্রবাদ প্রবচন ইত্যাদিও বেশ সমৃদ্ধ। ত্রিপুরাদের নাচ ও গান অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ঐতিহ্যবাহী সেসব গানের মধ্যে ইতোমধ্যে ২টি গীতিকাব্য গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে।

 

এই দু’টি গ্রন্থের নাম হলো- ১) লাংগৈ রাজানো বুমানি ও ২) পুন্দা তানমানি। এ ধরণের আরো বেশ কয়েকটি গীতিকাব্য যেমন–১) গঙ্গা তলীয় থাঁমানি, ২) গোঁসাই রাজ্যঅ থাঁমানি, ৩) কুচুক হা সিকাম কামানি, ৪) ‘হায়া বিদেশী থাঁমানি’, ৫) ‘খুন কামানি’ ইত্যাদি সাহিত্য সমৃদ্ধ গীতিকাব্য ত্রিপুরা জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে।

 

ত্রিপুরাদের নাচ-গান পরিবেশিত হয় সাধারণত বিবাহ অনুষ্ঠানে, পূজা পার্বণে ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে।ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী নাচগুলির মধ্যে গড়িয়া নৃত্য, কাথারক নৃত্য বা বোতল নৃত্য, হজাগিরি নৃত্য, কেরপূজা নৃত্য, মাইমিতা নৃত্য অন্যতম।

 

ত্রিপুরাদের বয়নশিল্প ও পোশাকের নকশা বেশ সমৃদ্ধ। নানা ধরণের পরিধেয় বস্ত্র প্রতিটি ঘরে তৈরি হয়ে থাকে।ত্রিপুরারা জুম চাষ করে। জুমচাষ থেকে কার্পাস উৎপন্ন হয়। এই কার্পাস থেকে ত্রিপুরা রমণীরা সুতা উৎপাদন করে। কার্পাস বা তুলা থেকে সুতা কিভাবে তৈরি করা হয় এবং সুতায় রং করার প্রযুক্তি ত্রিপুরা রমণীরা প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার করে আসছে। এই রং করা সুতা দিয়ে ত্রিপুরা রমণীরা সুন্দর সুন্দর নকশা সম্বলিত বিভিন্ন পরিধেয় বস্ত্র তৈরি করে থাকে।

 

ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা:-ত্রিপুরাদের আউটদূর খেলাধুলার মধ্যে অন্যতম হলো সুকই, গুদু, চু বা চুর, ওয়াসৌলাই, পর খেলা, হাতিতি, ওযাক-মৌসা, ওয়াংদে ইত্যাদি এবং ইনডোর খেলাধুলার মধ্যে তকঃ, চেচঙ, পাইং, খগ্রি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

 

শিক্ষা:-ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার একেবারে কম। তবে এ বিষয়ে সরকারিভাবে কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ১৯৯৮ সালে এডিবি কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের ৬৫.৫১%, মারমাদের ৫৩.১৭%, বাঙ্গালিদের ৫২.৬০% শিক্ষার হারের বিপরীতে ত্রিপুরাদের শিক্ষার হার মাত্র ২৭.২৪%।

 

রাষ্ট্র ও সরকারি সুযোগ-সুবিধার বঞ্চনা, অদিবাসী বান্ধবহীন শিক্ষা নীতিমালা, শিক্ষা চেতনার অভাব ইত্যাদি কারণে ত্রিপুরারা শিক্ষা-দীক্ষায় বেশ পিছিয়ে আছে।ত্রিপুরাদের গ্রামীণ জীবন, তাদের ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বিদ্যালয় থাকে না, যুগ যুগ ধরে শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চনা, শিক্ষা দীক্ষায় ত্রিপুরাদের অনগ্রসরতার অন্যতম কারণ।

 

আর্থ-সামাজিক অবস্থা:-ত্রিপুরাদের প্রধান পেশা কৃষি। কৃষির মধ্যে রয়েছে জুমচাষ, লাঙ্গলচাষ ও ফলবাগান চাষ। এ সব চাষের সাথে জড়িত চাষীদের বাইরে রয়েছে চাকরীজীবী, কতিপয় ব্যবসায়ী ও দিনমজুর। এছাড়া সমাজে আর একটি পেশাজীবী রয়েছে যারা প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল। তারা জঙ্গল থেকে লাকড়ি, শন, তরকারী ইত্যাদি সংগ্রহ করে বিক্রি করে জীবনধারণ করে।

 

ত্রিপুরা জাতির মাঝে ব্যবসা করে এমন লোকের সংখ্যা নিতান্ত কম। সে কারণে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক দৈন্যতা খুব বেশি পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। ‘জুম চাষ’ ত্রিপুরাদের জীবন-জীবিকার প্রধান পেশা। সহজ সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ত্রিপুরা অদিবাসীরা অতীতে মূলত জুম চাষের উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। জুমের উপর ভিত্তি করেই ত্রিপুরাদের অর্থনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ত্রিপুরাদের নাচ, গান, ছড়া, গল্প, মূল্যবোধ, বাদ্য-যন্ত্র, পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি গড়ে উঠেছে জুম চাষকে কেন্দ্র করে।

 

পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য অদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতো ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর আবাদী ভূমি ও বাস্তুভিটা বেহাত হয়ে যাচ্ছে। ভূমির উপর তাদের প্রথাগত অধিকারকে পদদলিত করে সরকার তাদের জুমভূমি বনায়ন, ইকো-পার্ক, পর্যটন কেন্দ্র, সামরিক স্থাপনা, অভিবাসী বাঙ্গালি বসতি প্রদান ইত্যাদি অজুহাতে অধিগ্রহণ করে চলেছে।তথ্যসূত্র:-১) পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি- সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ২) বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনজাতি- বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, ২০০১ খ্রিষ্টাব্দ ৩) পূব-ই রাবাইনি সাল- বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ, ১৯৮১ খ্রীষ্টাব্দ ৪) ত্রিপুরা জাতির মানিক্য উপাখ্যান- প্রভাংশু ত্রিপুরা, ১৪১০ ত্রিপুরাব্দ ৫) The Tripuras of Chittagong Hill Tracts- Baren Tripura, 1978 ৬) চট্টগ্রামের ইতিহাস- পূর্ণচন্দ্র দেববর্মা ৭) ত্রিপুরার ইতিহাস- ড. সুপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায় ৮) রাজমালা- কালী প্রসন্ন সেন। লেখকঃ শান্তুনু ত্রিপুরা। প্রসঙ্গঃ কিশোর মানিক্য, ত্রিপুরা, ত্রিপুরা জাতি, ত্রিপুরা মহারাজা, ধন্য মানিক্য, মহাভারত, রত্ন মাণিক্য, রাজমালা (সংগ্রহীত)।

বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।
সেহরির শেষ সময় - ভোর ৪:০২
ইফতার শুরু - সন্ধ্যা ৬:৩১
  • ফজর
  • যোহর
  • আছর
  • মাগরিব
  • এশা
  • সূর্যোদয়
  • ৪:০৭
  • ১১:৫৯
  • ৪:৩১
  • ৬:৩১
  • ৭:৫০
  • ৫:২৪