স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। বহু ধর্ম ও মতবাদে রয়েছে স্বাধীনতার কথা। ইসলাম আল্লাহ তায়ালার মনোনীত সর্বশেষ দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের বয়ানেও রয়েছে স্বাধীনতা। বর্ণিত হয়েছে স্বাধীনতার অপরসীম গুরুত্বের কথা। নিম্নে স্বাধীনতা সংশ্লিষ্ট আয়াত ও হাদিসগুলো তুলে ধরা হলো।
আল কোরআনে স্বাধীনতা লাভের চেষ্টার বর্ণনা
যেসব মুসলমান অমুসলিমদের অধীনে বসবাস করার কারণে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারে না, তাদের উপর আবশ্যক হলো সেখান থেকে হিজরত করা, যেন নতুন এলাকায় গিয়ে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারে। এ জন্য মক্কায় স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করা অসম্ভব হলে মুসলমানরা প্রথমে হাবশায় ও দ্বিতীয়বার মদীনায় হিজরত করে। সামর্থ্য থাকা সত্বেও যারা পরাধীনতাকে বেছে নেয়, আল কোরআন তাদেরকে জালেম ও নিজেদের অনিষ্ট সাধনকারী সাব্যস্ত করেছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ যাদের জান ফেরেশতারা এ অবস্থায় বের করে যে, ওরা নিজেদের অনিষ্ট সাধনে রত- ফেরেশতারা বলে, ‘তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? ওরা বলে, ‘আমরা যমীনের বুকে অন্যের অধীনে অসহায় অবস্থায় ছিলাম,’ ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর পৃথিবী কি এমন প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করে পূর্নবাসন হতে পারতে? অতএব এরূপ লোকদের বাসস্থান জাহান্নাম, আর তা কত নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল।’ (সূরা নিসা, আয়াত নং-৯৭) নিজেদের দ্বীনদারি পালনে স্বাধীনতার জন্য যুগে যুগে মুসলমানরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে হিজরত করেছে, কিন্তু কখনো দ্বীনদারি পালনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে দেয়নি। মুসলমানদের মাঝে এ ধরনের স্বাধীনতার প্রয়াস ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে চলে আসছে।
আল কোরআনে স্বাধীনতার জন্য দ্বিতীয় যে প্রয়াসের কথা বর্ণিত হয়েছে তা হচ্ছে সশস্ত্র যুদ্ধ। পরাধীনতার কারণে কোনো সম্প্রদায় নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হলে, তাদেরকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছ। যারা মজলুম মানবতার পক্ষে দাঁড়ায় না, ওদেরকে আল্লাহ তায়ালা ভৎসনা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের কী হলো যে, তোমরা যুদ্ধ করো না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য? যারা বলে, ‘হে আমাদের রব! আমাদের এই জনপদ থেকে বের করে নিয়ে যান, যার অধিবাসীরা অত্যাচারী। আর আপনার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য কোনো অভিভাবক নির্ধারণ করে দিন এবং নিযুক্ত করে দিন আপনার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী।’ (সূরা নিসা, আয়াত নং-৭৫)
স্বাধীনতা আল্লাহর তরফ থেকে নেয়ামত
এই ইতিহাস সবাই জানি যে, ফেরাউন ও তার সম্প্রদায় বনি ইসরাইলকে গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে রেখেছিল। হজরত মূসা (আ.) এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। অপমান থেকে মুক্তি দেয়া ও স্বাধীনতার সৌভাগ্য দানে ধন্য করাকে আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলের জন্য নেয়ামত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ (স্মরণ করো) যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলেন, ‘তোমরা নিজেদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করো, যখন তিনি ফেরাউনের লোকদের থেকে তোমাদের মুক্ত করলেন- ওরা তোমাদের নিকৃষ্ট আযাব দিত এবং তোমাদের পুত্রদের যবেহ করত ও নারীদেরকে দাসী-বাদী বানিয়ে জীবিত রাখতো। আর এতে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে বিরাট অনুগ্রহ ছিল।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত নং-৬) অন্যত্র ইরাশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আমি মূসা ও হারুনের প্রতিও অনুগ্রহ করেছি। তাদের ও তাদের সম্প্রদায়কে মুক্ত করেছি মহা সংকট থেকে। আর আমি তাদের সাহায্য করেছি, ফলে তারাই হয়েছে বিজয়ী।’ (সূরা সাফ্ফাত, আয়াত নং-১১৪, ১১৫, ১১৬) পরাধীনতাকে মহা সংকট ও এর থেকে মুক্তিকে অনুগ্রহ বলা হয়েছে। তাই স্বাধীনতার নেয়ামতের ব্যাপারে কোন উদাসীনতা কাম্য নয়। বরং আল্লাহ প্রদত্ত এই নেয়ামতের কদর করা আমাদের উপর আবশ্যক। অন্যথায় পরাধীনতার ন্যায় মহা সংকট যে কোনো সময় নেমে আসতে পারে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
জালেমদের থেকে স্বাধীনতা লাভ ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায়
স্বাধীনতা আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে নেয়ামত। নেয়ামত দ্বারা আল্লাহ তায়ালা বান্দার পরীক্ষা নেন যে, স্বাধীনতা পেয়ে তারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে, নাকি পূর্ববর্তীদের ন্যায় অবাধ্য হয়ে যায়? তাই স্বাধীন জাতির উচিত জালেমের হাত থেকে স্বাধীন হওয়ার পর আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর যখন তুমি ও যারা তোমার সঙ্গে আছে তারা নৌকায় আরোহণ করবে, তখন বলবে, ‘শুকরিয়া আল্লাহর, যিনি আমাদের জালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’ (সূরা মুমিনুন, আয়াত নং-২৮) ইসলামের সবচেয়ে বড় বিজয় ছিল মক্কা বিজয়। আল কোরআনে সূরা ‘নাসর’ এ মক্কা বিজয় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, এবং লোকদের দেখবেন -দলে দলে দ্বীন ইসলামে প্রবেশ করতে, তখন আপনি স্বীয় রবের পবিত্রতা বর্ণনা করুন তার প্রশংসাসহ এবং তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবেন।’ এর দ্বারা প্রতীয়মাণ হয় যারা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে তাদের কাজও প্রশংসাযোগ্য। তাই আল্লাহর শুকরিয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধদেরও প্রশংসা করা চাই।
স্বাধীনতার জন্য আল্লাহর বিশেষ বান্দাদের প্রার্থনা
জালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি লাভের জন্য হজরত নূহ (আ.) এভাবে দোয়া করেছেন, ‘অতএব আমার ও ওদের মাঝে একটা ফয়সালা করে দিন এবং আমাকে ও আমার সঙ্গে যে ঈমানদাররা আছে, তাদের মুক্তি দিন।’ (সূরা শুআরা, আয়াত নং-১১৮) হজরত মূসা (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা উল্লেখ করেন, ‘সুতরাং তিনি সেই শহর থেকে বের হয়ে গেলেন ভীত, অপেক্ষারত অবস্থায়। তিনি বলেন, ‘হে আমার রব! এই জালেম সম্প্রদায় থেকে আমাকে মুক্তি দিন। তারপর যখন তিনি তার নিকট এলেন এবং তার কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন, তখন তিনি বলেন, ‘ভয় পেয়ো না, তুমি জালেম সম্প্রদায় থেকে মুক্তি পেয়েছো।’ (সূরা কাসাস, আয়াত নং-২১-২৬)
হজরত উমর (রা.) এর ঘটনা
হজরত উমর (রা.) এর শাসনকাল। তার পক্ষ থেকে মিশরের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছেন হজরত আমর ইবনে আস (রা.)। এক কিবতির সঙ্গে হজরত আমর ইবনে আস (রা.) এর ছেলের ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা হয়। কিবতি বিজয়ী হলে আমর ইবনে আস (রা.) এর ছেলে তাকে আঘাত করে। ওই কিবতি বিচার নিয়ে মদীনায় হজরত উমর (রা.) এর কাছে যান এই আশঙ্কায় যে, মিশরে এর উপযুক্ত বিচার পাওয়া যাবে না। হজরত উমর (রা.) বিচারের জন্য আমর ইবনে আস (রা.) ও তার ছেলেকে মদীনায় ডেকে আনেন।
যে অন্যায় আচরণ কিবতির সঙ্গে করা হয়েছিল এর প্রতিশোধ নেয়ার পর হজরত উমর (রা.) বলেন, ‘কখন থেকে তোমরা মানুষকে গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ করেছো, অথচ তাদের মায়েরা তাদেরকে স্বাধীন অবস্থায় জন্ম দিয়েছে?’ হজরত উমর (রা.) বুঝাতে চেয়েছেন, মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মানেই হচ্ছে তাকে পরাধীন করে রাখা। হজরত রিবয়ী ইবনে আমের (রা.) পারস্যের বাদশার সামনে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘ইসলামের আগমন ঘটেছে মানুষকে মানুষের অধীনতা থেকে বের করে আল্লাহর গোলামীতে নিয়ে আসার জন্য।’
ইসলাম মূলত ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের ভিত্তিতে যুদ্ধ ও সংগ্রামের অনুমোদন দেয়। প্রচলিত জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে কারো থেকে আলাদা হওয়া বা কারো বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অনুমতি ইসলামে দেয় না। সুনানে আবু দাউদের এক হাদিসে এসেছে, নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে আসবায়্যিাতের দিকে লোকজনকে ডাকে সে আমার দলভূক্ত নয়। যে এর জন্য লড়াই করে এবং মারা যায় সে আমার দলভূক্ত নয়।’ আসাবিয়্যাত অর্থ হচ্ছে ন্যায়, অন্যায়ের তোয়াক্কা না করে শুধু আঞ্চলিকতা, ভাষা ও গোত্রপ্রীতির ভিত্তিতে লড়াই করা।