দেশটির লোকজন ‘বুরকিনাবে’ নামেই সমধিক পরিচিত। ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে দাপ্তরিক ভাষা ফরাসি হলেও দেশটির বেশির ভাগ লোকই মোরে ভাষায় কথা বলে। এ অঞ্চলের গোড়াপত্তনকারী মোসি জাতির নিজস্ব ভাষা এটি। সংখ্যায় এরা মোট জনসংখ্যার অর্ধেক হলেও আরও বিভিন্ন গোষ্ঠী-ভাষা এখানে বিদ্যমান। অর্ধেকের বেশি লোক মুসলমান। এক-পঞ্চমাংশ ক্যাথলিক খ্রিস্টান, এক-ষষ্ঠাংশ প্রথাগত ধর্মের অনুসারী এবং বাকি লোকজন প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে বুরকিনা ফাসো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে গেছে। ১৯৯১ সালে সংবিধান প্রণয়ন করে এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
প্রথম যুগেই বুরকিনা ফাসোতে ইসলামের আগমন ঘটে। তখন অবশ্য এটি আলাদা ভূখণ্ড ছিল না। বরং ঘানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে এ অঞ্চলের ইসলামের ইতিহাস। তাই বুরকিনা ফাসোতে ইসলামের আগমনে তিনটি পর্যায়ের কথা ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন।
প্রথম পর্যায় : ৬৪০ থেকে ১০৫০ খ্রিস্টাব্দ। মিসরসহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো জয় করার পর মুসলিম সেনাবাহিনী পশ্চিম আফ্রিকার দিকে অগ্রসর হয়। রোমান সৈন্যদের পরাজিত করে তারা এ অঞ্চলে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন। রোম সাম্রাজ্যের সহযোগী স্থানীয় জাতিগোষ্ঠী বিশেষত বার্বার জাতির পরাজয়ও নিশ্চিত হয় এ যুদ্ধে। তবে বার্বার জাতির ইসলাম গ্রহণের আশায় মুসলমানরা তাদের সঙ্গে সন্ধি করে নেয়।
দ্বিতীয় পর্যায় : দশম শতাব্দীর শেষের দিকে বার্বার জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান, রোমান সৈন্যদের আক্রমণ এবং মরক্কোর শাসকদের ষড়যন্ত্রের কারণে এ অঞ্চলে ইসলামের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। তবে একাদশ শতকে আফ্রিকান মুসলিমদের সম্মিলিত প্রয়াসে বার্বার জাতির একটি বড় অংশ ইসলাম গ্রহণ করে। ফলে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত তাদের হাতেই এ অঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বার্বার জাতি ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঘানার শাসকদের পরাজিত করে ক্ষমতা হাতে নেয়। ফলে তাদের মাধ্যমে অনেক মানুষই ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
তৃতীয় পর্যায় : অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে মুসলিম দাঈদের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ইসলামের পুনরুত্থান ঘটে। আফ্রিকার অনেক মুসলিম শাইখ ও দাঈ এখানে ইসলামের পুনর্জাগরণে মনোযোগী হন। তাদের মধ্যে শাইখ উসমান ডানফোডিয়ো, মুহাম্মদ আমিন কানিমি, হাজি উমর ইবনে ইদরিস, মুহাম্মদ আল-মাহদির নাম বুরকিনা ফাসোসহ পশ্চিম আফ্রিকার ইসলামের ইতিহাসে সোনালি হরফে লেখা থাকবে।
১৯১৯ সালে বুরকিনা ফাসো ফ্রান্সের উপনিবেশে পরিণত হলে মুসলমানদের পতন হয়। রাজনীতি ও শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়ে তারা। ষাটের দশকে ফ্রান্স দেশ ছাড়লেও এ দেশের মুসলমানদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেনি। মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তারা সংখ্যালঘু খ্রিস্টান শাসকগোষ্ঠীর করতলে শাসিত ও নির্যাতিত হয়ে আসছে। উপনিবেশকাল থেকে সরকারি স্কুলগুলোতে ফরাসি কৃষ্টি-কালচার পাঠ্য হওয়ায় মুসলমানরা তা থেকে দূরে থাকে। ফলে প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ময়দানে পিছিয়ে পড়ে তারা।
প্রাচীনকাল থেকে বুরকিনা ফাসোতে গ্রাম্য মক্তবভিত্তিক ধর্মশিক্ষা চালু ছিল। উপনিবেশকালে সরকারি স্কুলের বিকল্প হিসেবে মুসলমানরা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে এ দুটি শিক্ষাব্যবস্থাই চালু আছে। তবে মক্তবভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায় স্থানীয় ভাষায় কোরআন-হাদিস ও ইসলামি জ্ঞান শিক্ষা দেন প্রথাগত ধর্মশিক্ষকরা। পক্ষান্তরে মাদ্রাসাগুলোতে আরবি ভাষা শেখানোর মাধ্যমে ইসলামের উৎস-জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত করানো হয়। সাম্প্রতিককালে অল্পসংখ্যক মুসলিম তরুণ উচ্চমাধ্যমিক স্তর শেষ করে আরববিশ্বে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাচ্ছে। ফলে মুসলমানদের ধর্মশিক্ষায় নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে।
আকিদা-বিশ্বাসে বুরকিনা ফাসোর মুসলমানরা শতভাগ সুন্নি। অবশ্য সঠিক জ্ঞানের অভাবে ধর্মীয় কুসংস্কারও আছে অনেকের মধ্যে। মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো বহুধাবিভক্ত। অবশ্য প্রত্যেক দলই মুসলিমদের স্বনির্ভরতার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
দারিদ্র্য-মন্দার দেশ বুরকিনা ফাসোর মুসলমানরা সামাজিকভাবে অনেকটাই কোণঠাসা। অবশ্য সম্প্রতি দেশ-বিদেশের মুসলিম দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো বুরকিনা ফাসোতে কাজ করছে, তবে তা নিতান্তই নগণ্য। এ অঞ্চলে মুসলমানদের ইমান-আকিদা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে মুসলিম সেবাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও বেশি এগিয়ে আসতে হবে।