একঘরে হয়ে পড়েছেন পুরান ঢাকার দাপুটে নেতা এমপি (সংসদ সদস্য) হাজী সেলিম। সরকারি জমিসহ তাদের একের পর এক দখলদারি ও চাঁদাবাজির ঘটনায় বিস্মিত সরকারের হাইকমান্ড।এত অন্যায়-অপরাধ করেও এমপি সেলিম ও তার ছেলে কীভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে-তা নিয়েও খোঁজখবর নিচ্ছেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা।
এই এমপিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে যারা দখলদারি, চাঁদাবাজিসহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন, তাদের বিরুদ্ধেও ‘কঠোর অ্যাকশনে’ যাওয়ার ‘মেসেজ’ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা হল-‘অপরাধ করলে এমপি হলেও ছাড় নয়।’
ফলে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় ছেলে ইরফান সেলিম আটকের পর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় ধরনা দিয়েও সাড়া পাচ্ছেন না হাজী সেলিম।
সে কারণে আদালতের বিচারেই ফয়সালা হবে ইরফানের ভাগ্যে কী রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
ইরফান সেলিম ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর (সাময়িক বরখাস্ত)। তার বাবা ঢাকা-৭ আসনের ক্ষমতাসীন দলের এমপি।
শ্বশুর নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের এমপি মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী। ফলে শুধু বাবার দিক থেকে নয়; বরং শ্বশুরের দিক থেকেও ক্ষমতাধর ছিলেন ইরফান সেলিম।
ইরফানের গ্রেফতার অভিযানে যুক্ত র্যাবের একাধিক সূত্র যুগান্তরকে জানায়, গ্রেফতার করা হতে পারে-এমনটি ভাবতেও পারেননি তিনি। যে কারণেই নৌবাহিনী কর্মকর্তাকে মারধরের পরও ছিলেন স্বাভাবিক।
এ ঘটনার রাতেও বাসায় এসে বিদেশি মদ পান করেছেন। সোমবার রাতে যখন তাকে নিচে নামানো হয়, তখন রাজসিক প্রাসাদ ‘চাঁন সরদার দাদা বাড়ি’র নিচে প্রচুর মানুষের ভিড় দেখে কিছুটা হতবাক হয়ে যান।
এরপর গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো এবং রিমান্ডে যাওয়া-সবকিছুই ছিল তার কল্পনার বাইরে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যেই জড়িত থাকুক, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
তাতে সে জনপ্রতিনিধি বা যত শক্তিশালী লোকই হোক না কেন-ছাড় দেয়া হবে না। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অপরাধীকে আইনের মুখোমুখি হতেই হবে।
নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, বিষয়টি আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। ঘটনার নিরপেক্ষ ও দ্রুত তদন্তের জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ যদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয় বা অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা করে, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
এ সময় তিনি বিভিন্ন অপরাধে পুলিশের ডিআইজিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কারাগারে থাকার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।
জানা গেছে, ২০১৬ সালে স্ট্রোকের কারণে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলা হাজী সেলিম অসুস্থতার মধ্যেই ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। তবে শারীরিক অক্ষমতার কারণে তিনি সেভাবে সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন না।
এরই মধ্যে দীর্ঘদিন কানাডায় থাকা ছেলে ইরফান সেলিম দেশে ফিরে ৩০নং ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়ে কাউন্সিলর হন। মূলত তখন থেকেই চকবাজার এলাকায় ক্ষমতার জাল বিস্তার করে জমি দখলসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করেন তিনি।
গড়ে তোলেন নিজস্ব ‘নেটওয়ার্কিং সিস্টেম’ ও অন্তত অর্ধশত সদস্যের ‘স্পেশাল গার্ড’। তবে এসব কাজে কখনও কেউ তার বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাই অতীতের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকেই গ্রেফতারের সময় স্বাভাবিক ছিল ইরফান।
এদিকে ক্ষমতাসীন দলের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, অভিযানের কথা শুনে তার পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে লবিং-তদবিরের চেষ্টা করা হয়। তবে তাতে কাজ হয়নি।
কেউ কেউ তার পরিবারের কারও ফোনই ধরেনি। অনেকে কল ধরলেও এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
অপরাধীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কঠোর অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমানের কাছে। তিনি বলেন, এমপি বা জনপ্রতিনিধি হোক-কেউই অপরাধ করে পার পাবে না।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এই ‘মেসেজ’ দেয়া আছে। দেশে যে আইনের শাসন আছে, দেশে যে বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেন না-সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
সারা দেশে যারা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ও অপরাধে জড়িত-এটা অবশ্যই তাদের জন্যও একটা সতর্কবার্তা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রগুলো বলছে, শুধু হাজী সেলিম নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আরও কয়েকজন এমপি রয়েছেন তাদের তালিকায়। সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন করে-এমন কারও বিষয়ে আর নমনীয় থাকবে না ক্ষমতাসীন দলও।
সে কারণেই পুরান ঢাকায় দোর্দণ্ড প্রতাপে চলা হাজী সেলিমের বাসায় অভিযানের আগে তারা ‘গ্রিন সিগনাল’ পেয়েছেন। তাই চকবাজার এলাকায় ইরফান ও তার বাহিনীর শক্ত অবস্থান থাকার পরও র্যাবের অভিযানে কোনো ধরনের বাধা তৈরির সাহস দেখায়নি।
যদিও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই অভিযান পরিচালনা করে র্যাব। ‘চাঁন সরদার দাদা বাড়ি’-তে প্রবেশের আগে ও পরে চকবাজার ও আশপাশের পুরো এলাকা ছিল র্যাবের নিয়ন্ত্রণে।
মদিনা আশিক টাওয়ারে ইরফান সেলিমের টর্চার সেলের সন্ধান পায় র্যাব। চাঁদাবাজি ও দখলদারিতে এই টর্চার সেলের ব্যবহার হয়েছে বলে যুগান্তরকে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক এবং মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র বলছে, শুধু হাজী সেলিম ও তার ছেলে নয়; বরং দখলদারি ও চাঁদাবাজিতে যারা তাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করত, তারাও রয়েছেন নজরদারিতে। সেটা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হোক অথবা যেই হোক।
এদিকে ইরফান সেলিমের বিষয়ে পুলিশের শক্ত অবস্থানের কথা জানা যায় ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য থেকেও। মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নিঃসন্দেহে এই মামলা প্রভাবমুক্তভাবে তদন্ত করা হবে। এখানে প্রভাব খাটানোর চেষ্টাও কেউ করবে না। একজন অপরাধীকে যেভাবে বিচারের আওতায় আনা দরকার, একইভাবে তাকেও আনা হবে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে কমিশনার বলেন, আসামি কে, সেটা আমার দেখার বিষয় না। কে প্রভাবশালী, কে প্রভাশালী না-সেটা দেখার দায়িত্ব আমার না। আমার দেখার দায়িত্ব সে অপরাধ করেছে না-করেনি। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এখানে কোনো দল দেখা হচ্ছে না। অপরাধীদের বিরুদ্ধে নেত্রীর অবস্থান কঠোর।
যে দলেরই হোক, অপরাধীকে শাস্তি পেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে দলের তৃণমূলসহ সব পর্যায়ে কঠোর বার্তাও দেয়া হয়েছে।
গত রোববার রাতে নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধরের জেরে পরদিন সোমবার পুরান ঢাকার বড়কাটারায় ইরফানের বাবা সরকারদলীয় সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের বাড়িতে দিনভর অভিযান চালায় র্যাব।
এ সময় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত মাদক রাখার দায়ে ইরফানকে এক বছর কারাদণ্ড ও অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার কারণে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন।
ইরফানের দেহরক্ষী জাহিদকে ওয়াকিটকি বহন করার দায়ে ছয় মাস সাজা দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বুধবার ইরফান সেলিম ও তার দেহরক্ষী মো. জাহিদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।