অন্যান্য অঞ্চলের মতো এ অঞ্চলেও ‘হাজির-নাজির, ইলমে গায়েব এবং রসুলপাক নুরের তৈরি; মাটির তৈরি নন’ এরূপ ভ্রান্ত আকিদার আবর্জনা রয়েছে। ‘হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাটিতে’, ‘ওলামা-মাশায়েখদের ঘাঁটিতে’ এরূপ আকিদা খুবই পীড়াদায়ক ও দুঃখজনক। রসুল (সা.)-এর জন্য ইলমে গায়েব, হাজির-নাজির ইত্যাদি গুণ সাব্যস্ত করা ভ্রান্ত আকিদা। তবে এ ক্ষেত্রে নুরের সৃষ্টির আকিদাই হচ্ছে মৌলিক ভ্রান্তি; যা আল কোরআন, রসুল (সা.)-এর হাদিস ও মুসলিম মনীষীদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের নিরিখে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ রাখে। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি কেবল একটি আয়াতের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি-
আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আমি আদমসন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদের স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদের অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’
এ আয়াতের আলোকে চূড়ান্তভাবেই বলা যায়, আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে জাতিগতভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে মানব জাতি। আমার জানা মতে দার্শনিক আলেম ইবনে হাজম (রহ.) তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল মিলাল ওয়ান্নিহালে’ এ প্রসঙ্গে বলেন, আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম হলো আগুনের তৈরি জিন, নুরের তৈরি ফেরেশতা আর মাটির তৈরি মানুষ। তবে এর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে মানব জাতি। এ মানুষই সমগ্র সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। আর অন্যান্য সৃষ্টি হচ্ছে প্রাসঙ্গিক সৃষ্টি, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের প্রয়োজন মেটানো, মানুষের উপকার সাধন করা। এ কারণেই সমগ্র সৃষ্টি মানুষের অধীন এবং তার খেদমতে নিয়োজিত।
এ কারণেই সমস্ত সৃষ্টজগৎকে আল্লাহ আগে সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সবশেষে; যাতে মানুষ প্রয়োজন মেটাতে সমস্যার সম্মুখীন না হয়। মানুষের অবস্থানের জন্য আল্লাহ জমিন সৃষ্টি করেছেন। পায়ে চলার সুবিধার্থে জমিনকে সমতল বানিয়ে বিভিন্ন পথ ও রাস্তায় বিভক্ত করেছেন; বিরাট বিরাট পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করে জমিনকে প্রকম্পনমুক্ত ও স্থির করেছেন। দিনরাতের প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছেন চন্দ্র, সূর্য ও তারকারাজি। এগুলোকে ধারণ করার জন্য আসমান সৃষ্টি করে মহাশক্তির পরিচয় পেশ করেছেন। মানুষ যাতে দেখতে পারে সে জন্য সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য দৃশ্যমান বস্তু, শোনার জন্য ধ্বনি, বলার জন্য শব্দ ও বাক্য, আস্বাদনের জন্য ফল-মূল, দেহে শক্তি সঞ্চারের জন্য রংবেরঙের পানাহারসামগ্রী, আগুন, পানি, বাতাস, মাটিসহ অনেক কিছুই। এসব সৃষ্টির পেছনে অন্যতম লক্ষ্যবস্তু এটাই। সেই সঙ্গে দেহ যেহেতু বস্তু, স্থূলতা বিশিষ্ট তাই তার প্রয়োজনে অসংখ্য স্থূল বিষয় সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি।’ কেবল দেহকে মানুষ বলা হয় না। শুধু দেহের কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নেই। দেহ ও দেহের ক্রিয়ার মূল চালিকা হচ্ছে মানুষের আত্মা। এ আত্মার কারণেই দেহ ক্রিয়াশীল। এ কারণেই আত্মাবিহীন দেহ মূল্যহীন- মাটিতে পুঁতে রাখার যোগ্য। এ আত্মার সজীবতা এবং তাতে শক্তি সঞ্চারের জন্য রয়েছে ইমান, আমল, ইবাদত, রিয়াজতসহ অসংখ্য ব্যবস্থাপনা। এরই সাহায্যে আত্মায় শক্তি সঞ্চার হয়।