অটিজম এক ধরনের মানসিক বিকাশগত সমস্যা। যা সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে সামাজিক কার্যকলাপ, আচরণ, যোগাযোগ ও পারস্পারিক মিথিষ্ক্রিয়া বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে।
অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিসঅর্ডারের সঙ্গে আসলে ৪টি বিষয় জড়িত
এসপার্গারস সিন্ড্রোম, অটিস্টিক ডিসঅর্ডার, চাইল্ডহুড ডিসইন্টিগ্রেটিভ ডিসঅর্ডার এবং এটিপিকাল অটিজম। এদের মধ্যে অটিস্টিক ডিসঅর্ডার সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয় এবং অটিজম বলতে মূলত এটিকেই বোঝানো হয়। এই সমস্যাটি শিশুর জন্মের তিন বছরের মধ্যেই ধরা পড়ে। আমাদের দেশে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মাঝে কমপক্ষে ১৭ জন শিশু অটিজমে আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ২৪ জন ছেলে শিশু এবং১০ জন মেয়ে শিশু অটিজমে আক্রান্ত।
কারণ
অটিজম কেন হয়, তা আসলে এখনো পরিষ্কারভাবে জানা সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, কিছু জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণে অটিজম দেখা দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় অ্যালকোহল বা কিছু মৃগী রোগের ওষুধ সেবন করলে, গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত স্থূলতা বা ডায়বেটিস রোগে বা রুবেলায় আক্রান্ত হলে শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। মেয়ে শিশুর চেয়ে ছেলে শিশুর অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার হার প্রায় চার গুণ বেশি। বেশি বয়সে সন্তান নিলে শিশুর অটিজমের সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়। শহুরে, শিক্ষিত, ধনী পরিবারে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।
প্রাথমিক লক্ষণসমূহ
শিশু যদি অযথা হাসে, কোনো ভয় বা বিপদ না বোঝে, ব্যথা পেলে যদি না কাঁদে, একা থাকতে পছন্দ করে, কোনো খেলনা বা বস্তু অস্বাভাবিক পছন্দ করে, আদর পছন্দ না করলে বা না বুঝলে, অসংলগ্নভাবে একই খেলা বারবার খেলে, চোখের দিকে না তাকায়, একই কাজ বারবার করে, প্রশ্ন করলে উত্তর না দিয়ে একই প্রশ্ন করলে, অন্যদের সঙ্গে খেলতে বা মিশতে না চায়, নিজের চাওয়া বোঝাতে সমস্যা হয় বা অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করে, কোনো শব্দ হলে সেদিকে সাড়া না দেয় বা জোড়ে শব্দ হলে সহ্য করতে না পারে, একা একা ঘুরতে থাকে বা খেলনা ঘুরাতে থাকে, রুটিন পরিবর্তনের সঙ্গে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে না পারে, শিশুকে ধরলে বা কোলে উঠতে অপছন্দ করে, তাহলে প্রাথমিকভাবে অটিজম সন্দেহ করা যেতে পারে।
অটিজম এর চিকিৎসা
কোনো শিশু অটিজমে আক্রান্ত মনে হলে অনতিবিলম্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রাথমিক অবস্থায় অটিজম নির্ণয় করতে পারলে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অটিজম এর ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়াগুলো অনেক সফলভাবে মোকাবেলা করা যায়। শিশুর কি ধরনের অস্বাভাবিকতা আছে সেটা সঠিকভাবে নির্ণয় করে, নির্দিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সমন্বয়ে চিকিৎসা করলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
>> এই ধরনের শিশুদের জন্য প্রচুর বিশেষায়িত স্কুল আছে, সেখানে তাদের বিশেষভাবে পাঠদান করা হয়। এ ধরনের স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি পরামর্শ দেবেন, কোনো ধরনের স্কুল আপনার শিশুর জন্য উপযুক্ত হবে।
>> অনেক অটিস্টিক শিশুর কিছু মানসিক সমস্যা যেমন- অতিরিক্ত চঞ্চলতা, অতিরিক্ত ভিতি, ঘুমের সমস্যা, মনোযোগের সমস্যা ইত্যাদি থাকতে পারে। অনেক সময় এরকম ক্ষেত্রে চিকিৎসক শিশুটিকে ওষুধ দিতে পারেন।
>> নিবিড় ব্যবহারিক পরিচর্যা, স্কুল ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, সঠিক স্বাস্থ্য সেবা এবং প্রয়োজনে সঠিক ওষুধের ব্যবহার একটি শিশুর অটিজমের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেকখানি সহায়ক হয়। যথাযথ সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অটিস্টিক শিশুদের সঠিক ভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করতে হবে।
অটিজম প্রতিরোধে করণীয়
অটিজমের যেহেতু কোনো নিরাময় নেই, তাই সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই এটি প্রতিরোধ করতে হবে। পরিবারে কারো অটিজম অথবা কোনো মানসিক এবং আচরণগত সমস্যা থাকলে, পরবর্তী সন্তানের ক্ষেত্রে অটিজমের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে পরিকল্পিত গর্ভধারণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় অধিক দুশ্চিন্তা না করা, পর্যাপ্ত ঘুম, শিশুর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। আরো কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন-
> বেশি বয়সে বাচ্চা না নেয়া।
> বাচ্চা নেয়ার আগে মাকে রুবেলা ভেকসিন দিতে হবে।
> গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না।
> মায়ের ধূমপান, মদ্যপানের মতো কোনো অভ্যাস থাকলে বাচ্চা নেয়ার আগে অবশ্যই তা ছেড়ে দিতে হবে।
> বাচ্চাকে অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
অটিজম নিয়ে কিছু ভুল ধারণা
আমাদের অনেকের ধারণা, অটিজম একটি বংশগত রোগ। এটা সম্পূর্ণভাবে ঠিক নয়। সম্পূর্ণ সুস্থ বাবা মায়েরও অটিস্টিক শিশু হতে পারে। আবার অনেকের ধারণা সঠিক পরিচর্যার অভাবে শিশু অটিস্টিক হতে পারে। এটাও কিন্তু ঠিক নয়। অটিস্টিক শিশুকে অনেকে বাবা মায়ের অভিশাপ বলে থাকেন, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল এবং ভিত্তিহীন। অনেক শিশু জন্ম ও স্বভাবগতভাবেই একটু বেশি অস্থির, চঞ্চল, রাগী অথবা জেদি প্রকৃতির হতে পারে। এতেই কিন্তু বোঝা যায় না যে শিশুটি অটিস্টিক। শিশুর কোনো আচরণে অটিজমের লক্ষণ প্রকাশ পেলে দেরি না করে প্রাথমিক অবস্থাতেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আমাদের সমাজের নানান ভুল ধারনা ও কুসংস্কারের ফলে অনেক শিশুর ভুল চিকিৎসা হয়ে থাকে, যা শিশুর জীবনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।