নাগরিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শে-মার্কিন দূতাবাস
আস্থা ডেস্কঃ
জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরে গত ১৩ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যেসব দেশ নিষেধাজ্ঞা দেবে, আমরা তাদের কাছ থেকে কিছু কিনব না। এরপর থেকে বিদেশি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কথা হচ্ছিল বিভিন্ন দিক থেকে। এর মধ্যে সরকারের দুই মন্ত্রী গতকাল রোববার আবার বললেন নিষেধাজ্ঞার কথা।
যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশের ওপর আবার নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে? কী হতে পারে নিষেধাজ্ঞা? কারা পড়তে পারেন মার্কিনদের এই খাঁড়ায়? র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর বহাল আছে দেড় বছর আগের নিষেধাজ্ঞা। এসব বিষয় নিয়ে অনেকটা খোলামেলা কথা হচ্ছে সরকারে এবং সরকারের বাইরে বিভিন্ন মহল।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুল বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। দেশটিতে প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী পড়তে যায়। হাজার হাজার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ আছেন। এই অবস্থায় মার্কিনরা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে এবং দেশের রপ্তানি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে এমন আলোচনাও আছে।
এমন আলোচনার মধ্যে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশটির নাগরিকদের জন্য সতর্কতা জারি করেছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি অথবা তার আগেই নির্বাচন হতে পারে এবং এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো এরই মধ্যে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভসহ নানা কর্মকাণ্ড শুরু করেছে জানিয়ে দূতাবাস বলেছে, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, ততই এসব কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকবে।
মার্কিন নাগরিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে দূতাবাস বলেছে, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ যেকোনো সময় সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে। তাই বড় সমাবেশ এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে তাঁদের।
তবে পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে কোনো লাভ হয় না বলে মনে করেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ। গতকাল বার্তা সংস্থা বাসসের খবরে বলা হয়, সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘ইরানের বিরুদ্ধে অনেকেই স্যাংশন দিয়ে রেখেছে।
ইরানের সরকার তো পড়ে যায় নাই, বহাল তবিয়তে আছে। বহু বছরের স্যাংশনেও কিউবাকে টলানো যায় নাই, সরকারও পরিবর্তন হয় না।’হাছান মাহমুদ আরও বলেন, ‘মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরে বহু স্যাংশন, সেখানকার সরকারও পরিবর্তন হয়নি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে বহু স্যাংশন, সেগুলো অমান্য করেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং অনেকে তাদের কাছ থেকে পণ্য আমদানি করছে। অর্থাৎ, এগুলো দিয়ে আসলে লাভ হয় না।
তবে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রাজ্জাক অবশ্য মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা দেবে না।গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা তো কাউকে গ্রেপ্তার করি না, বাধাও দেওয়া হয় না। মানুষ পূর্ণ বাক্স্বাধীনতা ভোগ করছে। আমি বুঝি না নিষেধাজ্ঞা কেন দেবে? আমার ধারণা, তারা নিষেধাজ্ঞা দেবে না, বাস্তবতা বুঝবে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার যে আভাস, তা অনেক দিন ধরেই আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। র্যাবের ওপর আগের নিষেধাজ্ঞায় দেশটি কানাডা ও যুক্তরাজ্যকে সম্পৃক্ত করেছিল। তবে দেশ দুটি শেষ পর্যন্ত তাতে সাড়া না দিলেও এবার মার্কিনরা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে পশ্চিমা অন্য দেশ ও জোটগুলো যুক্ত হলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে বলে মনে করেন না বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।
শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমারা অনেক দিন ধরে সরকারের ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছে এবং এ নিয়ে উভয় পক্ষে ‘চাপা উত্তেজনা’ আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির। দেশগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলোর কথা বলছে, তা যদি বাস্তবভিত্তিক সমাধানের পথে না যায়, তাহলে সংঘাতের আশঙ্কা আছে বলে মনে করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক এই রাষ্ট্রদূত মনে করেন, আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে বাস্তবভিত্তিক সমাধানের পথ না খুললে সরকারকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে দেশটি কঠোর হলেও হতে পারে। নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে চাপ যে শুধু সরকারের ওপর আসতে পারে তা নয়, পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হলে, বিরোধী বিএনপির ওপরও চাপ আসতে পারে নির্বাচনে অংশ নিতে।
প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে কলকাঠি নাড়াসহ পশ্চিমাদের কাছে অনেক রকম হাতিয়ার আছে বলে মনে করেন প্রবীণ এই কূটনীতিক।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে বলে মনে করেন কি না, এমন প্রশ্নে বিইআইয়ের প্রেসিডেন্ট বলেন, বাংলাদেশ থেকে আমদানির ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞার সম্ভাবনা কম। কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি বাণিজ্যিক সুবিধা জিএসপি পিছিয়ে দেয়, তাতেও কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি হবে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই উদ্যোগে নিকট প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারত ও অন্য পরাশক্তি চীন অন্তত প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ থাকবে বলে মনে করেন (বিইআই) প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, ভারত ও চীন পরস্পরবিরোধী হলেও দুই দেশই নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায়।
সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞা দিলে কোনো লাভ হবে না। এ বিষয়ে হুমায়ুন কবির বলেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরির মাধ্যমে সমস্যা জটিল হওয়ার আগেই সমাধানের পথ খোঁজা উত্তম।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার রপ্তানির মধ্যে এককভাবে যুক্তরাষ্ট্রেই গেছে ১ হাজার ৪২ কোটি ডলারের পণ্য।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র উঠে এসেছে দ্বিতীয় স্থানে। গত বছর সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে সৌদি আরব থেকে, ৪৫৪ কোটি ডলার। এরপরই আছে যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, ৩৪৪ কোটি ডলার ও ২০৭ কোটি ডলার।
জাতিসংঘের চলতি বছরের ৩১ মার্চের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সৈন্য, পুলিশ ও বিশেষজ্ঞ—সব মিলিয়ে বিশ্ব সংস্থার শান্তি মিশনগুলোয় সর্বোচ্চসংখ্যক ৭ হাজার ২৩৭ জনশক্তির জোগান দিচ্ছে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ডলার-রুবলে শোধ করতে না পারায় সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঋণ পরিশোধ নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। চীনের মধ্যস্থতায় দেশটির মুদ্রা ইউয়ানে দায় শোধের সর্বশেষ উদ্যোগেও বাগড়া দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিদ্যুৎকেন্দ্রের রোসাটমের কয়েকটি সহযোগী সংস্থার ওপর গত ১২ এপ্রিল ওয়াশিংটনের জারি করা নিষেধাজ্ঞা উল্লেখ করে ঢাকায় দেশটির দূতাবাস পরদিন এক কূটনৈতিক পত্রে চীনা মুদ্রায় রাশিয়ার ঋণ পরিশোধে আপত্তি জানায়।
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং ব্যক্তি হিসেবে সংস্থার সাবেক ও তদানীন্তন সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা কর্মকর্তারা হলেন পুলিশের তদানীন্তন মহাপরিদর্শক ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক ও র্যাবের তদানীন্তন মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, র্যাবের তদানীন্তন অতিরিক্ত মহাপরিচালক খান মোহাম্মদ আজাদ, তিন সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, মো. জাহাঙ্গীর আলম ও মো. আনোয়ার লতিফ ও র্যাব-৭-এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দীন আহমেদ।
তাঁদের কারও কারও ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, কারও কারও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার কথা নিষেধাজ্ঞায় বলা আছে। এরপর বাংলাদেশ সরকার গত দেড় বছরে দফায় দফায় অনুরোধ করে এবং মার্কিন তদবিরকারক (লবিস্ট) নিয়োগ করার পরও এই নিষেধাজ্ঞা মার্কিনরা তুলে নেয়নি।