ঢাকা ১১:৫৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ২৯ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম:
Logo ইরানকে সহায়তা করায় ভারতীয়সহ ৩২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা Logo খাগড়াছড়িতে ১৮ বছর পর ধানের শীষের পথ সভায় ওয়াদুদ ভূইয়া Logo নতুন করে পদায়ন করা হলো আরও ৯ ডিসি Logo বাংলাদেশের ১১ জেলাকে সংযুক্ত করে বানাতে চায় ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ Logo সীমান্তে সেনা বাড়াচ্ছে ভারত-মিয়ানমার, বাংলাদেশ করছে প্রত্যাহার! Logo আ.লীগের আগ্রাসনের প্রতিবাদে পানছড়িতে যুবদলের বিক্ষোভ মিছিল Logo তাড়াইলে ধলা ইউপি চেয়ারম্যান ঝিনুক গ্রেফতার Logo কিশোরগঞ্জে চবি চাকসুর জিএস সাঈদ বিন হাবিবকে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা Logo কিশোরগঞ্জে জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত Logo খাগড়াছড়িতে আ.লীগের মিছিল: সাবেক প্রতিমন্ত্রীসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সীমান্তে সেনা বাড়াচ্ছে ভারত-মিয়ানমার, বাংলাদেশ করছে প্রত্যাহার!

Astha DESK
  • আপডেট সময় : ০৮:১৮:০৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
  • / ১০০৮ বার পড়া হয়েছে

সীমান্তে সেনা বাড়াচ্ছে ভারত-মিয়ানমার, বাংলাদেশ করছে প্রত্যাহার!

এ এইচ এম ফারুকঃ

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে সাম্প্রতিক সময়ে অস্থিরতা ও পুনর্গঠনের ঢেউ উঠেছে। ভারত তার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে একের পর এক সেনা ঘাঁটি স্থাপন করছে। যেমন, আসাম, উত্তর দিনাজপুর, বিহার, পশ্চিমবঙ্গের হাসিমারা বিমান ঘাঁটি ইত্যাদি সব জায়গায় রাফালে যুদ্ধবিমান, এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করা হয়েছে। মিজোরামে গঠিত হচ্ছে টেরিটোরিয়াল আর্মি ব্যাটালিয়ন, যা স্বাধীনতার ৭৮ বছর পর প্রথম।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজপরিবারের সদস্য প্রদ্যোত বিক্রম মানিক্য দেব বর্মা প্রকাশ্যে দাবি করেছেন যে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল আসলে ত্রিপুরার ঐতিহাসিক ভূখণ্ড। এই অঞ্চল দখল করে ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের হুমকি দিয়ে ভারত সরকারের কাছে তিনি এই ভূখণ্ড দখলের জন্য ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন। এই বক্তব্য শুধু ইতিহাসের বিকৃতি নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি উস্কানি। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রকে নতুন মাত্রায় উন্মোচিত করেছে। এর আগে থেকেই এই অঞ্চলে ‘জুম্মল্যান্ড’ এবং ‘কুকি-চীনল্যান্ড’ নামে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ও প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

অন্যদিকে, রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর সংঘাত নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে, যার প্রভাব বাংলাদেশের সীমান্তে উদ্বাস্তু প্রবাহ, অস্ত্র পাচার এবং নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। যা ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে একটি জাতিগত-ভ‚রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ যেন এক নীরব দর্শক। যখন প্রতিবেশীরা সীমান্তে কৌশলগত প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ কওে চলেছে ঠিক উল্টো। পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো স্পর্শকাতর সীমান্তে কয়েকশ সেনা ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়েছে। এই বৈপরীত্য শুধু কৌশলগত নয়, এটি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার ও আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম: ভূরাজনৈতিক হৃদস্পন্দন

পার্বত্য চট্টগ্রাম একাধারে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে এবং বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি অবস্থান করে একটি কৌশলগত ত্রিভুজ তৈরি করেছে। অথচ গত দুই দশকে এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২৪১টি সেনা ক্যাম্প গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির (কথিত শান্তি চুক্তি) পর এই ক্যাম্প প্রত্যাহার শুরু হয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে- সেনা প্রত্যাহারের পর ইউপিডিএফ, জেএসএসসহ সশস্ত্র সংগঠনগুলোর তৎপরতা বেড়েছে। চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, অস্ত্র এবং মাদাক পাচার সবই বেড়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে অনেক বছর ধরে সেনা ক্যাম্প বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও সম্প্রতি ২৫০টি নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এখনো এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি নেই।

ভারতের সীমান্তে কৌশলগত পুনর্গঠন

২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে ভারত আসাম, উত্তর দিনাজপুর ও বিহারে তিনটি নতুন সেনা ঘাঁটি স্থাপন করেছে বলে জানিয়েছে গণমাধ্যম। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের হাসিমারা বিমান ঘাঁটিতে রাফালে যুদ্ধবিমান ও এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও মোতায়েন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’: ফেনী করিডোর ও মিরসরাই

বাংলাদেশের নিজস্ব ‘চিকেন নেক’ অঞ্চল হলো ফেনী করিডোর। যা রামগড়, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান হয়ে চট্টগ্রামকে দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে। এই করিডরের সরু ভূখণ্ড কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার। এই অঞ্চলেই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে ১,১৫০ একর জমি বিনামূল্যে বরাদ্দ দিয়েছিল একটি ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের জন্য। যদিও প্রকল্পটি পরে স্থগিত হয়, তবুও এর অবস্থান বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ ফেনীর কাছেই। ফলে এর অবস্থান বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ ফেনীর কাছে হওয়ায় একটি কৌশলগত প্রশ্ন উঠে। প্রশ্ন উঠে, এই অঞ্চলে ভারতীয় ব্যবসায়ী ও কর্মী বাহিনীর পরিচয়ের আড়ালে ভারতীয় সেনা বা গোয়েন্দা সদস্যদের অবস্থান নিশ্চিতভাবে নাকচ করার গ্যারান্টি কোথায়? এমনকি যদি প্রকল্পটি অর্থনৈতিক হয়, তবুও এর অবস্থান ও নিয়ন্ত্রণের ধরন কৌশলগতভাবে স্পর্শকাতর। কারণ, ভারতের নিজস্ব ‘চিকেন নেক’ শিলিগুড়ি করিডর- যা উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে, সেখানে ভারত বহু বছর ধরে রাফালে, এস-৪০০, সেনা ঘাঁটি, রেল ও সড়ক অবকাঠামো গড়ে তুলেছে কৌশলগত নিরাপত্তার অংশ হিসেবে।

তাই প্রশ্নটা শুধু জমি বরাদ্দ নয়, বরং বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি ও নিরাপত্তা কাঠামো কতটা সক্রিয়- এই প্রশ্নের উত্তর এখন জাতীয় নিরাপত্তার অংশ।

রাখাইন সংকট: সীমান্তে নতুন হুমকি

রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘাত বেড়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে বিদ্রোহী অভিযান শুরু হয়, যা মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দেয়। এই সংঘাতের ফলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাসহ কয়েকশ নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। সীমান্তের ওপার থেকে গুলি ও মর্টার শেল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পড়েছে, যা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এখনও সীমান্ত এলাকায় বার্মিজদের অনধিকার চর্চা লক্ষ করা যাচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় নীরবতা ও রাজনৈতিক অগ্রাধিকার

এই বাস্তবতায়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা নীতিতে একটি মৌলিক পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। সীমান্তে সেনা ক্যাম্প গুটিয়ে নেওয়া নয় বরং কৌশলগতভাবে পুনঃস্থাপন জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রাম, ফেনী, রামগড়- এই অঞ্চলগুলোতে স্থায়ী ক্যান্টনমেন্ট, আধুনিক নজরদারি ব্যবস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বিত নিরাপত্তা কাঠামো গড়েস তোলা জরুরী।

বিভাজন নয়, সমন্বিত ও সর্বদলীয় নিরাপত্তা নীতি প্রয়োজন

পার্বত্য চট্টগ্রাম, জাতীয় নিরাপত্তা ও সীমান্ত সুরক্ষা ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐক্যমত এখন সময়ের দাবি। রাষ্ট্রের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা, সীমান্তে সশস্ত্র তৎপরতা, এবং বহিরাগত হুমকি মোকাবিলায় দলীয় বিভাজন নয়- একটি সমন্বিত, সর্বদলীয় নিরাপত্তা নীতি প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে জুম্মল্যান্ড, কুকি-চীনল্যান্ড কিংবা গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ডের মতো ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা শুধু কোনো একটি দলের নয়, গোটা জাতির অস্তিত্বের বিরুদ্ধে। তাই এই অঞ্চলের নিরাপত্তা, সেনা উপস্থিতি এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংবিধানসম্মত ও সর্বদলীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা জরুরি, যাতে জাতীয় স্বার্থে কোনো ফাঁক না থাকে।

অথচ রাজনীতিবিদরা এখন সংস্কার, গণভোট, ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত। অথচ সীমান্তে এক বহুমাত্রিক যুদ্ধ এগিয়ে আসছে। ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাংলাদেশের দৃষ্টিতে তা এখনো অন্ধকারে। এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, রাষ্ট্রকে তার ভূরাজনৈতিক মানচিত্র নতুন করে পড়তে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ট্যাগস :

সীমান্তে সেনা বাড়াচ্ছে ভারত-মিয়ানমার, বাংলাদেশ করছে প্রত্যাহার!

আপডেট সময় : ০৮:১৮:০৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫

সীমান্তে সেনা বাড়াচ্ছে ভারত-মিয়ানমার, বাংলাদেশ করছে প্রত্যাহার!

এ এইচ এম ফারুকঃ

দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে সাম্প্রতিক সময়ে অস্থিরতা ও পুনর্গঠনের ঢেউ উঠেছে। ভারত তার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে একের পর এক সেনা ঘাঁটি স্থাপন করছে। যেমন, আসাম, উত্তর দিনাজপুর, বিহার, পশ্চিমবঙ্গের হাসিমারা বিমান ঘাঁটি ইত্যাদি সব জায়গায় রাফালে যুদ্ধবিমান, এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করা হয়েছে। মিজোরামে গঠিত হচ্ছে টেরিটোরিয়াল আর্মি ব্যাটালিয়ন, যা স্বাধীনতার ৭৮ বছর পর প্রথম।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজপরিবারের সদস্য প্রদ্যোত বিক্রম মানিক্য দেব বর্মা প্রকাশ্যে দাবি করেছেন যে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল আসলে ত্রিপুরার ঐতিহাসিক ভূখণ্ড। এই অঞ্চল দখল করে ‘গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ড’ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের হুমকি দিয়ে ভারত সরকারের কাছে তিনি এই ভূখণ্ড দখলের জন্য ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন। এই বক্তব্য শুধু ইতিহাসের বিকৃতি নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি উস্কানি। এটি পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্রকে নতুন মাত্রায় উন্মোচিত করেছে। এর আগে থেকেই এই অঞ্চলে ‘জুম্মল্যান্ড’ এবং ‘কুকি-চীনল্যান্ড’ নামে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা ও প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

অন্যদিকে, রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর সংঘাত নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে, যার প্রভাব বাংলাদেশের সীমান্তে উদ্বাস্তু প্রবাহ, অস্ত্র পাচার এবং নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। যা ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের সীমান্তজুড়ে একটি জাতিগত-ভ‚রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ যেন এক নীরব দর্শক। যখন প্রতিবেশীরা সীমান্তে কৌশলগত প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ কওে চলেছে ঠিক উল্টো। পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো স্পর্শকাতর সীমান্তে কয়েকশ সেনা ক্যাম্প গুটিয়ে নিয়েছে। এই বৈপরীত্য শুধু কৌশলগত নয়, এটি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার ও আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম: ভূরাজনৈতিক হৃদস্পন্দন

পার্বত্য চট্টগ্রাম একাধারে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে এবং বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি অবস্থান করে একটি কৌশলগত ত্রিভুজ তৈরি করেছে। অথচ গত দুই দশকে এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২৪১টি সেনা ক্যাম্প গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির (কথিত শান্তি চুক্তি) পর এই ক্যাম্প প্রত্যাহার শুরু হয়। কিন্তু বাস্তবতা বলছে- সেনা প্রত্যাহারের পর ইউপিডিএফ, জেএসএসসহ সশস্ত্র সংগঠনগুলোর তৎপরতা বেড়েছে। চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, অস্ত্র এবং মাদাক পাচার সবই বেড়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে অনেক বছর ধরে সেনা ক্যাম্প বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও সম্প্রতি ২৫০টি নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এখনো এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি নেই।

ভারতের সীমান্তে কৌশলগত পুনর্গঠন

২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে ভারত আসাম, উত্তর দিনাজপুর ও বিহারে তিনটি নতুন সেনা ঘাঁটি স্থাপন করেছে বলে জানিয়েছে গণমাধ্যম। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের হাসিমারা বিমান ঘাঁটিতে রাফালে যুদ্ধবিমান ও এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও মোতায়েন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’: ফেনী করিডোর ও মিরসরাই

বাংলাদেশের নিজস্ব ‘চিকেন নেক’ অঞ্চল হলো ফেনী করিডোর। যা রামগড়, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান হয়ে চট্টগ্রামকে দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে। এই করিডরের সরু ভূখণ্ড কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার। এই অঞ্চলেই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে ১,১৫০ একর জমি বিনামূল্যে বরাদ্দ দিয়েছিল একটি ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের জন্য। যদিও প্রকল্পটি পরে স্থগিত হয়, তবুও এর অবস্থান বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ ফেনীর কাছেই। ফলে এর অবস্থান বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ ফেনীর কাছে হওয়ায় একটি কৌশলগত প্রশ্ন উঠে। প্রশ্ন উঠে, এই অঞ্চলে ভারতীয় ব্যবসায়ী ও কর্মী বাহিনীর পরিচয়ের আড়ালে ভারতীয় সেনা বা গোয়েন্দা সদস্যদের অবস্থান নিশ্চিতভাবে নাকচ করার গ্যারান্টি কোথায়? এমনকি যদি প্রকল্পটি অর্থনৈতিক হয়, তবুও এর অবস্থান ও নিয়ন্ত্রণের ধরন কৌশলগতভাবে স্পর্শকাতর। কারণ, ভারতের নিজস্ব ‘চিকেন নেক’ শিলিগুড়ি করিডর- যা উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করে, সেখানে ভারত বহু বছর ধরে রাফালে, এস-৪০০, সেনা ঘাঁটি, রেল ও সড়ক অবকাঠামো গড়ে তুলেছে কৌশলগত নিরাপত্তার অংশ হিসেবে।

তাই প্রশ্নটা শুধু জমি বরাদ্দ নয়, বরং বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি ও নিরাপত্তা কাঠামো কতটা সক্রিয়- এই প্রশ্নের উত্তর এখন জাতীয় নিরাপত্তার অংশ।

রাখাইন সংকট: সীমান্তে নতুন হুমকি

রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘাত বেড়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে বিদ্রোহী অভিযান শুরু হয়, যা মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দেয়। এই সংঘাতের ফলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাসহ কয়েকশ নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। সীমান্তের ওপার থেকে গুলি ও মর্টার শেল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পড়েছে, যা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এখনও সীমান্ত এলাকায় বার্মিজদের অনধিকার চর্চা লক্ষ করা যাচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় নীরবতা ও রাজনৈতিক অগ্রাধিকার

এই বাস্তবতায়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা নীতিতে একটি মৌলিক পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। সীমান্তে সেনা ক্যাম্প গুটিয়ে নেওয়া নয় বরং কৌশলগতভাবে পুনঃস্থাপন জরুরি। পার্বত্য চট্টগ্রাম, ফেনী, রামগড়- এই অঞ্চলগুলোতে স্থায়ী ক্যান্টনমেন্ট, আধুনিক নজরদারি ব্যবস্থা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বিত নিরাপত্তা কাঠামো গড়েস তোলা জরুরী।

বিভাজন নয়, সমন্বিত ও সর্বদলীয় নিরাপত্তা নীতি প্রয়োজন

পার্বত্য চট্টগ্রাম, জাতীয় নিরাপত্তা ও সীমান্ত সুরক্ষা ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐক্যমত এখন সময়ের দাবি। রাষ্ট্রের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা, সীমান্তে সশস্ত্র তৎপরতা, এবং বহিরাগত হুমকি মোকাবিলায় দলীয় বিভাজন নয়- একটি সমন্বিত, সর্বদলীয় নিরাপত্তা নীতি প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে জুম্মল্যান্ড, কুকি-চীনল্যান্ড কিংবা গ্রেটার ত্রিপুরা ল্যান্ডের মতো ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণা শুধু কোনো একটি দলের নয়, গোটা জাতির অস্তিত্বের বিরুদ্ধে। তাই এই অঞ্চলের নিরাপত্তা, সেনা উপস্থিতি এবং প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংবিধানসম্মত ও সর্বদলীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা জরুরি, যাতে জাতীয় স্বার্থে কোনো ফাঁক না থাকে।

অথচ রাজনীতিবিদরা এখন সংস্কার, গণভোট, ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত। অথচ সীমান্তে এক বহুমাত্রিক যুদ্ধ এগিয়ে আসছে। ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ‘চিকেন নেক’ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাংলাদেশের দৃষ্টিতে তা এখনো অন্ধকারে। এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, রাষ্ট্রকে তার ভূরাজনৈতিক মানচিত্র নতুন করে পড়তে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক