মহামারি করোনার কারণে বেকায়দায় পড়েছে । ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় পারছেন না দেশে আসতে। ওদিকে নেই কাজ। এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে না পেরে যে কোনো ভাবে দেশে আসতেই উদ্বিগ্ন প্রবাসীরা। তেমনই এক সিঙ্গাপুর প্রবাসীর কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরেছেন আরেক সিঙ্গাপুর প্রবাসী ওমর ফারুকী শিপন।
যা হুবুহু তুলে ধরা হলো:
৩০ জনের ম্যাসেজের রিপ্লাই ও ১০ থেকে পরের জনের সঙ্গে কথা বলার পর নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগছিলো। ঠিক সে সময় একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে বারবার কল আসছে। শরীরটা এতই খারাপ লাগছিলো যে কল রিসিভ করতে ইচ্ছে করছিলো না। সারাদিন কাজ করার পর কতক্ষণ আর মোবাইলে কথা বলা বা ম্যাসেজের রিপ্লাই দেয়া যায়!!
এমন সময় আমার পরিচিত কবি কিরন মাহমুদ মান্না কল দিলেন। উনি কোন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কল দেন না। তাই ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও কলটা রিসিভ করলাম। মোবাইলের ওপাশ থেকে তিনি সালাম দিয়ে বললেন, ওমর ভাই আমার এক বন্ধু দেশে যাবার জন্য কান্নাকাটি করছে প্লিজ তার জন্য কিছু করুন৷ সে আপনাকে কল দিচ্ছে তার কলটা রিসিভ করে কিছু বলুন। সে আপনার কথা শুনলে একটু শান্ত হবে৷
কিরন ভাইয়ের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। একজন প্রবাসী কতটা কষ্ট পেলে দেশে যাবার জন্য কান্নাকাটি করতে পারে৷ আমি তার সঙ্গে কথা শেষ করে অপরিচিত নাম্বারে কল ব্যাক করলাম৷ সে কল রিসিভ করেই কান্না শুরু করে দিলো। কান্নার কারণে তার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। এমনভাবে কান্না করছে যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছি না৷ মানুষের কান্না আমাকে ব্যথিত করে। নিজেরও কান্না চলে আসে৷ ইচ্ছে করে নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগ করে হলেও তারমুখে হাসি ফুটাই।
আমি তাকে শান্ত হবার জন্য বললাম। তবুও সে কান্না করে যাচ্ছে৷ আমি বললাম, ভাই আপনার কান্নার কারণে কথা বুঝতে পারছি না। কান্না থামিয়ে পারলে আমাকে কল দিয়েন। আর কথা না বাড়িয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলাম।
কিছুক্ষণ পর সে যা বলল, তার মূল বক্তব্য বলো, তার মা অসুস্থ, স্ত্রী অসুস্থ এই মুহূর্তে দেশে যাওয়া তারজন্য জরুরি। আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, প্লিজ কান্না করবেন না। দেখি আপনার জন্য কিছু করতে পারি কিনা৷
সে কিছুটা শান্ত হলো। তার সঙ্গে কথা শেষ করে একজনকে কল দিলাম (তার নাম পরিচয় অন্য কোনদিন প্রকাশ করবো) এই মানুষটির একটা জিনিসের প্রশংসা আমাকে করতেই হবে। শত ব্যস্ততার মাঝেও আমার ম্যাসেজ পেলে তিনি ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে কল ব্যাক করবেন৷ সেদিনও ৫ মিনিটের মধ্যে কল দিয়ে বললেন, ভাই আমি মিটিং এ আছি জরুরি কিছু কি বলবেন? আমি বললাম, হ্যাঁ ভাই, একজন বাংলাদেশী ভাই দেশে যাবার জন্য কান্নাকাটি করছে তারজন্য কিছু করা যায় কি?
তিনি বললেন, ভাই এখন যারা দেশে যাবার জন্য এপ্লাই করেছে তারা সবাই জরুরি কারণেই যাবে। তাই সিরিয়াল অনুসারে যখন তার নাম আসবে তখন যেতে পারবে। আমি বললাম, ভাই উনার কোম্পানি উনাকে দেশে পাঠানোর ব্যাপারে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। এমনকি তাকে দেশে পাঠাতে আগ্রহী নয় তাই সে কান্না করছে৷ তিনি কথা সংক্ষিপ্ত করে বললেন, ঠিক আছে উনার নাম্বার দিন আমি কথা বলে বিস্তারিত জেনে নেই৷
তিনি আর কথা বাড়ালেন না৷ তবে এত ব্যস্ততার মাঝেও কল ব্যাক করার জন্য তাকে ধন্যবাদ দেই৷ এরপর প্রতিদিনই সুমন ভাই দৈনিক ৫ থেকে ৬ বার কল করে কান্নাকাটি করেন আর বলেন, ভাই একটা টিকেট দিয়ে আমাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তাকে বুঝিয়ে বলি, ভাই দেশে পাঠানোর ব্যাপারে আমার কোনকিছু করার নেই আমি এখানে সাধারণ শ্রমিক। তবুও চেষ্টা করছি আপনার জন্য কিছু করার৷
তবুও সে আমার কথা মানতে রাজি নয়৷ বারবার একই কথা বলে, ভাই আমাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
দুইদিন পর সুমন ভাই ম্যাসেজ দিয়ে বললেন, ওমর ভাই আপনার ওই লোক আমাকে কল দিয়েছিলেন৷ আমার বসের নাম্বার নিয়ে বসকে কল দিয়েছে। এখন বস বলছে খুব শীঘ্রই আমাকে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে৷ তার ম্যাসেজ দেখে খুশি হলাম। আমি ম্যাসেজ রিপ্লাই করে লিখলাম, ভাই ধৈর্য হারা হবেন না। সবসময় আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন ইনশাআল্লাহ সমস্যার সমাধান হবে। আর দেশে যাওয়ার আগে আমাকে একটা কল দিয়েন।
এরপর সুমন ভাইয়ের কল বা ম্যাসেজ পাই না। ভাবলাম সে হয়তো দেশে চলে গেছে কিন্তু আমাকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করেনি৷ তার প্রতি নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করছে।
কিন্তু আমার সব ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে সে সাতদিন পর সে কল দিয়ে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,ভাই আমি দেশে চলে আসছি৷ এখন মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে আছি৷ তার কথা শুনে খুব ভালোলাগল। আমি মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছি কিন্তু আজকে তার কান্না আমার ভালোলাগছে। সব কান্না বেদনাদায়ক নয় কিছু কিছু কান্না আনন্দদায়কও হয়৷ আমার কাছে আনন্দদায়ক কান্না পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য।