ফোরজির যুগ চলছে, এর মধ্যেই ফাইভজির বিস্ময় পৃথিবীর সামনে। বাংলাদেশও যুক্ত হতে চলেছে এর সঙ্গে। সে জন্য প্রস্তুতি নেওয়াও শুরু হয়েছে। চলতি বছরের মধ্যেই দেশে পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি চালু হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের মাধ্যমে সীমিত পরিসরে চালু হবে এই সেবা।
বুধবার (১৯ মে) ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এ তথ্য জানিয়েছেন। মন্ত্রী বলেন, বর্তমান প্রযুক্তিগত বিশ্ব বাস্তবতায় এখনই বিস্তৃত পরিসরে ফাইভজি নয়, তাই ফোরজি সেবাকে আরও মানসম্পন্ন করার বিষয়েও জোর দেওয়া হচ্ছে।
টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহাব উদ্দিন জানান, আগামী ডিসেম্বরের শুরুতেই পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি চালু করবে টেলিটক। তার জন্য এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে।
এদিকে, ফাইভজি প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে দুটি চীনা কোম্পানি- জেডটিই করপোরেশন ও হুয়াওয়ে।
ফাইভজিতে যা থাকছে
আগের থ্রিজি ও ফোরজি প্রযুক্তিতে মোবাইল ইন্টারনেটের গতি বেড়েছে। সেই গতি আরও অনেক বাড়িয়ে দেবে ফাইভজি। এ প্রযুক্তির কারিগরি দিক একেবারেই আলাদা। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, থ্রিজি ও ফোরজি প্রযুক্তিতে বেতার তরঙ্গ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেসব দুর্বলতা রয়েছে, ফাইভজিতে তা নেই। এ প্রযুক্তিতে অনেক কম বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে অনেক বেশি মানসম্পন্ন সেবা ও দ্রুতগতি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। ফাইভজি চালুর শুরুতে বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন হলেও সেবাদান পর্যায়ে অপারেটররা অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা দিতে পারবে। গ্রাহকরাও একটা পর্যায়ে আগের চেয়ে কম টাকায় উন্নত সেবা পাবেন। তবে এই সেবা সাধারণ গ্রাহকের চেয়ে শিল্প উৎপাদন এবং বৃহৎ ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য বেশি উপযোগী। সাধারণ গ্রাহকের জন্য ফোরজি সেবাই এখন পর্যন্ত আদর্শ সেবা।
ফাইভজির মাধ্যমে হাই ডেফিনেশন বা উন্নততর ভিডিওচিত্র আদান-প্রদান সম্ভব হবে খুব সহজে। এর ফলে টেলিচিকিৎসা, টেলিক্লাসরুমের মতো পদ্ধতিগুলো যেমন আরও জনপ্রিয় হবে, তেমনি ‘স্মার্টসিটি’র নতুন ধরনের সেবা চালু সহজ হবে। ‘স্মার্ট কার পার্কিং’, স্মার্ট ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, ভবনের স্মার্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সিটি করপোরেশনের মতো জনসেবা দেওয়া সংস্থাগুলোও সেবার ক্ষেত্রে স্মার্ট ব্যবস্থা চালু করতে পারবে। স্মার্ট শিল্পকারখানা ব্যবস্থাও চালু সম্ভব হবে। উন্নত কয়েকটি দেশে শিল্পকারখানায় এই ‘স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট’ সিস্টেম চালু হয়েছে, যা তাদের পরিচালনা ব্যয়ও অনেকখানি কমিয়ে দিয়েছে।
এর পাশাপাশি প্রত্যন্ত যেসব অঞ্চলে ফাইবার অপটিক কেবল নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, সেখানে ফাইভজির মাধ্যমে মোবাইল ব্রডব্যান্ড সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বর্তমানে ফোরজি সেবায় দেশে ৪৫ এমবিপিএস (মেগাবাইট পার সেকেন্ড) পর্যন্ত গতিতে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা দেওয়া সম্ভব হয়। এমবিপিএস ক্লাস প্রযুক্তিতে এই গতি পাওয়া যাচ্ছে। গিগাবাইট ক্লাস প্রযুক্তি ব্যবহার করলে গতি পরিমাণ এক হাজার এমবিপিএস বা এক জিবিপিএস পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু ফাইভজিতে গতি হবে ৫ জিবিপিএস থেকে ১০ জিবিপিএস পর্যন্ত। অর্থাৎ ফোরজির তুলনায় ফাইভজিতে ইন্টারনেটের গতি হবে পাঁচ থেকে দশ গুণ বেশি।
প্রযুক্তিপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতি :চীনা প্রতিষ্ঠান জেডটিই জানিয়েছে, মোবাইল অপারেটরদের ফোরজি সেবাকে পঞ্চম প্রজন্মের সেবায় রূপান্তর করতে ‘ডায়নামিক স্পেকট্রাম শেয়ারিং (ডিএসএস)’ প্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। জেডটিই সুপার ডিএসএস নামে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বর্তমান তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের নেটওয়ার্কের সেবা বজায় রেখে ট্রাই রেডিও অ্যাকসেস টেকনোলজির মাধ্যমে পঞ্চম প্রজন্মের বা ফাইভজি প্রযুক্তিতে রূপান্তর ঘটায়। প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকায় এ প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়েছে।
তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের তরঙ্গ সেবায় মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের বরাদ্দ করা ১৫ মেগাহার্টজ ব্যান্ডউইথ সীমার মধ্য থেকে ২ দশমিক ১ গিগাহার্টজ স্পেকট্রামে জেডটিইর সুপার ডিএসএস প্রযুক্তির বাস্তবায়ন করা হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অপারেটরদের নেটওয়ার্ক পরীক্ষায় দেখা গেছে, ২ দশমিক ১ গিগাহার্টজ তরঙ্গে ফাইভজি চালু করা সম্ভব।
চীনের অপর বৃহৎ প্রযুক্তিপণ্য নির্মাতা ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফাইভজির পরীক্ষামূলক সেবা চালু করেছে। কোম্পানিটি বাংলাদেশে ফাইভজি প্রযুক্তির সম্ভাবনার দিকগুলো নিয়ে একটি প্রদর্শনী করেছে। কভিড-১৯ মহামারির আগেই ‘ইনোভেশন টু অ্যাডভান্স ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রদর্শনীতে বাংলাদেশে ফাইভজির সম্ভাবনার অনেক দিক তুলে ধরেছে। বিশেষ করে স্মার্ট সিটি গড়ে তোলার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে মানুষের এগিয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। সর্বশেষ চলতি বছরে চীনের সেনজেন শহরে এবং ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের সংযুক্ত করে অনুষ্ঠিত হুয়াওয়ের গ্লোবাল অ্যানালিটিক সম্মেলন-২০২১-এর আয়োজনেও পুরো আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল সামনের বছরগুলোতে ফাইভজির সম্ভাবনা।
কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?
এর আগে থ্রিজি ও ফোরজি সেবা নিয়ে বাংলাদেশের গ্রাহকদের মধ্যে সমালোচনা থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে, টুজির চেয়ে থ্রিজিতে গতি বেশি হয়েছে, ফোরজিতে হয়েছে আরও বেশি। এখন বাংলাদেশের গ্রাহকরা স্মার্টফোনে হাই ডেফিনেশন ভিডিও দেখতে পাচ্ছেন ফোরজি সেবা ব্যবহার করেই।
একটি মোবাইল ফোন অপারেটরের একজন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফাইভজি চালুর ক্ষেত্রে অপারেটরদের বড় বিনিয়োগের বিষয় আছে। এ ছাড়া বেতার তরঙ্গের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফাইভজির জন্য আদর্শ বেতার তরঙ্গ হচ্ছে ২৬০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড। পাশাপাশি অন্য ১৮০০ ও ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডেও সেবা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সরকারি নীতিতে সুলভে বেতার তরঙ্গ দেওয়ার এবং সঠিক ব্যান্ডের বেতার তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়ার নীতি গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, থ্রিজি ও ফোরজির ক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটররা বেতার তরঙ্গ সুলভে পায়নি। ফলে উচ্চ বিনিয়োগ করে লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে। ফাইভজিতে অপারেটররা এই ঝুঁকি নিতে চায় না।
এখন ফোরজি সেবার মান আরও উন্নত করতেই অপারেটররা বেশি নজর দিচ্ছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, কভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বজুড়েই ফাইভজি প্রযুক্তি চালুর বিষয়টি পিছিয়ে গেছে; বরং ফোরজি প্রযুক্তির সেবার মান বাড়ানোর দিকেই এখন বড় দেশগুলোও নজর দিচ্ছে। বাংলাদেশও একই ধরনের নীতি গ্রহণ করেছে। এর আর একটা বড় কারণ হচ্ছে, ফাইভজি মূলত সাধারণ গ্রাহকের জন্য উপযোগী নয় বা অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী প্রযুক্তি। এটা উপযোগী শিল্পপণ্য উৎপাদন খাত, বড় ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকসের মতো যে নতুন শিল্পে বিশ্ব প্রবেশ করবে, সেখানে ফাইভজি খুবই উপযোগী বিবেচিত হবে। তবে বাংলাদেশও ফাইভজি চালুতে পিছিয়ে থাকবে না। চলতি বছরের মধ্যেই টেলিটকের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে ফাইভজি চালু হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করেছে টেলিটক।