জাতীয় পতাকা স্বাধীনতার প্রতীক, স্বার্বভৌমত্বের প্রতীক। জাতী পতাকা একটি দেশের পরিচয় বাহক। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে নকশা করা হয় বিভিন্ন দেশের জাতীয় পতাকা? আম্বার কিছু কিছু দেশের জাতোত পতাকার মধ্যে থাকে অদ্ভুত মিল। কিন্তু কেন? চলুন পৃথিবীর প্রধান কিছু দেশের জাতীয় পতাকার নকশার পেছনের গল্পটা জেনে নেই।
বাংলাদেশ
আমাদের জাতীয় পতাকার সবুজ রং এদেশের প্রকৃতি ও সজীবতার প্রতীক বুঝায়। আর সবুজের মাঝে থাকা লাল বৃত্ত উদীয়মান সূর্য, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্তের প্রতীক বুঝায়। আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার এ নকশা ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সরকারিভাবে অনুমোদিত হয়।
জাপান
আমরা সাদা পটভূমির মাঝে লাল চাকতি দেখতে পাই জাপানের পতাকায়। বাংলাদেশের পতাকার সাথে বেশ মিল পাওয়া যায়, তাই না? পতাকার লাল চাকতিটি আসলে উদীয়মান সূর্যের প্রতীক। জাপানে কথিত আছে, বেশ কয়েক শতক পূর্বে জাপানি লোকজন তাদের সম্রাটকে সূর্য দেবী আমাতেরাসুর উত্তরসূরি বলে মনে করতেন।
এরপর ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মঙ্গোলরা জাপান আক্রমণ চালায়। ঐসময় বৌদ্ধ ভিক্ষু নিচিরেন নিজেদের প্রতীক হিসেবে সূর্য খচিত পতাকাটি প্রস্তাব করেন। এরপর ধীরে ধীরে এই লাল সূর্যই জাপানের প্রতীক হয়ে ওঠে আর এভাবেই জাপানিজরা পায় তাদের জাতীয় প্রতীক।
স্ক্যান্ডিনেভিয়া
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাষ্ট্রগুলো, অর্থাৎ, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও আইসল্যান্ডের পতাকাগুলোর নকশা বলতে গেলে প্রায় একই ধরনের বলা চলে । দেশগুলোর পতাকায় ক্রস চিহ্ণ অঙ্কিত আছে।
আয়তাকার ক্ষেত্রের উপর এক কিংবা দুই রং বিশিষ্ট অঙ্কিত এই ক্রসকে বলা হয় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ক্রস অথবা নর্ডিক ক্রস। এই ক্রসটি একপাশে এমনভাবে চাপানো থাকে যাতে করে ঐ পাশের চৌকোনা ক্ষেত্র দুটি বর্গাকার দেখা যায়।
মূলত ১০৯৫ থেকে ১২৯১ সাল পর্যন্ত খ্রিস্টানদের বেশকিছু যুদ্ধে ক্রস বিশিষ্ট পতাকার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এরপর থেকে ডেনমার্কের রাজারা তাদের যুদ্ধের পতাকাগুলোতে এই ক্রসের ব্যবহার শুরু করেন।
বর্তমান সময়ে নর্ডিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নরওয়ে প্রথম এই নকশাটি গ্রহণ করে ১৮২১ সালে। তারপর ১৯০৬ সালে সুইডেন এই ক্রস অনুযায়ী নিজেদের পতাকার নকশা করে।
পরবর্তী সময়ে গ্রীনল্যান্ড বাদে অন্যান্য প্রতিবেশী নর্ডিক রাষ্ট্রগুলোও তাদের ধর্ম, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে একই ধরনের পতাকার নকশা গ্রহণ করে।
নেপাল
এই দেশের জাতীয় পতাকাটি একটু আলাদা বলা চলে। এটি পৃথিবীতে বর্তমানে টিকে থাকা একমাত্র জাতীয় পতাকা যেটি চারকোনা আকৃতির নয়। দুটো ত্রিভুজকে পরপর সাজিয়ে এই পতাকার নকশা করা হয়েছে।
এই ত্রিভুজ দুইটি সেখানকার রাজবংশের দুই অংশের প্রতীক বুঝায় । আর রক্তিম বর্ণ নেপালের জাতীয় ফুল রডোডেনড্রনের প্রতিনিধিত্ব করে।
পতাকার নীল প্রান্ত শান্তির প্রতীক।
লেপালে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এই পতাকার অর্ধ চন্দ্র ও সূর্য়্যে মানুষের মুখ অংকিত থাকত। কিন্তু পরবর্তিতে তা বাদ দেয়া হয়।
যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যের পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক নামে পরিচিত যা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন পতাকা। এখানে মূলত তিনটি ক্রস চিহ্ন দেয়া রয়েছে।
এই ক্রস তিনটি দেশের ধর্মযাজকদের প্রতিনিধিত্ব করে বলে জানা যায়। আর এতে অঙ্কিত মোটা লাল দাগ ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের সেন্ট জর্জের ক্রস, সাদা রং স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রু ক্রস আর আড়াআড়ি লাল দাগ উত্তরাঞ্চলীয় আয়ারল্যান্ডের সেন্ট প্যাট্রিক ক্রসকে বুঝায় ।
যুক্তরাজ্যে ১৮০১ সালে এ নকশার পতাকা গ্রহণ করা হয়েছিলো।
ফ্রান্স
ফ্রান্স নীল-সাদা-লাল রঙয়ের পতাকা গ্রহণ করে ১৭৯৪ সালে । এর তিনটি রং ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ স্বরূপ স্বাধীনতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্বের প্রতীক বুঝায় । আর এতে প্রদত্ত নীল ও লাল রং প্যারিসের প্রতীক। পতাকায় থাকা সাদা রং ফরাসি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত ফ্রান্স শাসন করা বার্বন রাজবংশের সম্মানার্থে রাখা হয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা
নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তি উপলক্ষে ১৯৯৪ সালে নতুন পতাকা ধারণ করে দক্ষিণ আফ্রিকা। আফ্রিকায় ম্যান্ডেলার সমর্থণকারী দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের রঙয়ের সঙ্গে মিলিয়ে পতাকার কালো, সবুজ আর লাল রং নেয়া হয়।
আফ্রিকান রাজ্যের পুরোনো পতাকা থেকে লাল, সাদা ও নীল রং গুলো নেয়া হয়েছে। আর ইংরেজি ওয়াই বর্ণের আকৃতি দেশটির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে চলছে।
ব্রাজিল
এই দেশের পতাকার সবুজ অংশটি দেশটির বিশাল বনভূমি ও শস্যক্ষেত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। আর হলুদ হীরক আকৃতির চিহ্ন দেশটির স্বর্ণখনির প্রতীক। মাঝের বড় নীল পৃথিবী ও এর ওপর ২৭টি তারকা ২৭টি রাজ্যের প্রতীক। আর পৃথিবীর ওপর লেখা ‘অরডেম-ই-প্রগ্রেসো’, যার অর্থ শৃঙ্খলা ও উন্নতি।
অস্ট্রেলিয়া
আস্ট্রেলিয়ার পতাকার রং নীল। এতে তিন ধরনের প্রতীক দেখা যায়। পতাকার বাম পাশে উপরে ব্রিটেনের পতাকা, এর নিচে সাত কোণা বিশিষ্ট সাদা তারা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতীক বুঝায় । এটিসহ মোট ছয়টি তারা ছয়টি রাজ্যের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
কানাডা
ম্যাপল পাতার নকশায় কানাডার দৃষ্টিনন্দন এই পতাকা সরকারি স্বীকৃতি পায় ১৯৬৫ সালে । পতাকাটির বিখ্যাত ১১ কোণা বিশিষ্ট ম্যাপলপাতাটি কানাডার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতীক। এছাড়া পতাকার ব্যবহৃত লাল-সাদা রং আশা, উন্নতি, শান্তি ও নিরপেক্ষতার প্রতীক।
মালয়েশিয়া
এই দেশটির পতাকার লাল, সাদা ও নীল রঙের অর্থ সেদেশে মানুষ। হলুদ রঙের আংশিক চাঁদ এবং তারা দেশটির রাষ্ট্রীয় ধর্মের পরিচায়ক। হলুদ রঙটি সে দেশের শাসকরা অন্য দেশের হাতে পরাধীন নয় এটি মনে করিয়ে দেয়, মানে এই রং। পতাকার লাল-সাদা রঙের ১৩টি দাগ ১৩টি রাজ্যের প্রতীক। আর ১৪তম দাগ রাষ্ট্রীয় ঐক্যের প্রতীক।