প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী সরকারি হওয়া ৩০২টি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি আত্তীকরণের (সরকারি করা) জন্য নথিপত্র পরিদর্শনের নামে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নেয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কলেজ শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে এই ঘুষের কারবার করছেন। কোনো শিক্ষক-কর্মচারীর নথিপত্রের ‘বেমিল’ থাকলেই ‘মুশকিল আসান’ হিসেবে আবির্ভূত হয় ‘ঘুষ’। ঘুষের এই কারবারের জন্য মাউশির কলেজ শাখা এখন জমজমাট। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, আত্তীকরণে ঘুষের অভিযোগ তদন্তে মাউশির ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মনোয়ার হোসেনকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়। গত রমজানের পর ১২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন মাউশিতে জমাও হয়েছে। তবে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে বহাল তবিয়তেও রয়েছেন অভিযুক্ত কর্মকর্তারা। শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি সরকারিকরণের নামে ঘুষ নেয়া, তদন্ত কমিটি গঠন, তদন্ত প্রতিবেদন জমা- এর কোনোটিই জানে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে মন্ত্রণালয়ও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, আমি তদন্ত রিপোর্টের কথা জানি না। অবশ্যই খোঁজ নিয়ে জেনে ব্যবস্থা নেব। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের দিক থেকে এর কোনো
ব্যত্যয় ঘটেনি এখনো। তবে সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি জহুরুল ইসলাম বলেন, এসব বলে লাভ নেই। বললেই শত্রæ হতে হয়, কাজ হয় না। এজন্য এখন আর এসব নিয়ে কোনো কিছুই বলি না।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মাউশির কলেজ শাখার সহকারী পরিচালক দেলোয়ার হোসেনকে ঘুষ না দেয়ায় তথ্য জালিয়াতির অভিযোগ এনে মাদারীপুরের রাজৈর ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মরিয়ম মুজাহিদার চাকরি আত্তীকরণ হয়নি। অথচ তার চাকরি আত্তীকরণের জন্য স্থানীয় সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান ‘ডিও’ লেটার পর্যন্ত দিয়েছেন।
মসজিদ ধ্বংসের বিষয়ে চীনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ছড়ানোর অভিসন্ধি: চীনের পররাষ্ট্র
শুধু রাজৈর কলেজ নয়, অনুসন্ধানে অন্তত আরো ৪টি কলেজের ক্ষেত্রে ঘুষ দেয়ার তথ্য প্রমাণ পেয়েছে। অন্য কলেজগুলোর ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেনের অকাট্য প্রমাণ না থাকলেও অধিকাংশই বলেছেন, কোনো না কোনোভাবে তাদেরও ঘুষ দিতে হয়েছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের বক্তব্যও স্পষ্ট। তারা বলেছেন, ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হচ্ছে না। এজন্যই ঘুষ দিচ্ছি। একই সঙ্গে ঘুষের বিনিময়ে কাজও চাই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঘুষ না দেয়ায় তথ্য জালিয়াতির অভিযোগে মাদারীপুরের রাজৈর ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মরিয়ম মুজাহিদার চাকরি সরকারি না হওয়ার পর মাউশিতে অভিযোগ দেন অধ্যক্ষের স্বামী আনোয়ার হোসেন আরমিন মোল্লা। তিনি বলেন, মাউশির কলেজ শাখার সহকারী পরিচালক দেলোয়ার হোসেনসহ আরো কয়েকজন ২ লাখ টাকা ঘুষ এবং পরিবহন খরচের নামে ২০ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন। সেই দাবি পূরণ করতে না করায় ৪০ বছরের পুরনো একটি তথ্যের ঘাটতি দেখিয়ে মরিয়ম মুজাহিদার চাকরিই আত্তীকৃত হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে মাউশির কলেজ শাখার সহকারী পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, জাতীয়করণ হওয়া কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্তীকরণের সময় বহুজনের নথিপত্রে ঘাপলা পাওয়া গেছে। সঙ্গত কারণেই ত্রæটিপূর্ণ কাগজের মালিকের চাকরি আত্তীকৃত হবে না। যাদের আত্তীকৃত হবে না তারা নানা অভিযোগ করবে। এ নিয়ে আমরা বিব্রত।
রাজৈর কলেজের সাবেক অধ্যক্ষের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি হওয়া কোনো কলেজ পরিদর্শনে যাওয়ার পর এমনিতেই কলেজ কর্তৃপক্ষ খাওয়া-দাওয়া করায়, গাড়ি ভাড়াও দিয়ে দেয়। গাড়ি ভাড়া দিয়ে এখন বলছে- ঘুষ। এত অন্যায়। কেন অন্যায়- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাকে ফাঁসানোর জন্য একটি চক্র এই বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। এছাড়া সংসদ সদস্য শাজাহান খানও এ বিষয়ে আমাকে ডেকেছিলেন। কিন্তু ওই কলেজের শিক্ষকদের দুগ্রুপের সমস্যার কারণে তার চাকরি আত্তীকৃত হয়নি। চাকরি আত্তীকৃত না হওয়ায় তিনি আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছেন।
অভিযোগটি কি সত্যি নয়- এর জবাবে তিনি বলেন, মাউশির ঢাকা অঞ্চলের পরিচালকের নেতৃত্বে আমার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। সেখানেই যা বলার আমি বলেছি। ওরা যে অভিযোগ করেছে সেটা আমার সঙ্গে ঘটেনি। ওই অধ্যক্ষের চাকরি কি সরকারি হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার চাইলে হবে। নতুবা যতদিন চাকরি আছে ততদিন তিনি সরকারি কলেজে এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে জীবন কাটাতে পারবেন।
ঘুষকাণ্ডের তদন্ত কর্মকর্তা মাউশির ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মনোয়ার হোসেন বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন মাউশি মহাপরিচালকের কাছে জমা দিয়েছি। তদন্তে ঘুষ নেয়ার সত্যতা পেয়েছিলেন কি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর। এজন্য আমি কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।
মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনটি কোথায় যে আছে, তা খুঁজে দেখতে হবে। প্রতিবেদনটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে কি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাও খুঁজে দেখতে হবে। বুঝতেই তো পারছেন, না খুঁজে কিছুই বলতে পারছি না।
এদিকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা কলেজও সরকারি হয়েছে। এখন শিক্ষক-কর্মচারীর চাকরি আত্তীকরণের কাজ চলছে। এ অবস্থায় কলেজটির একজন প্রদর্শকের নিয়োগ-সংক্রান্ত জটিলতা পাওয়া যায়। জটিলতা থেকে রেহাই পেতে ওই প্রদর্শক মাউশিতে আবেদন করেন। এরপর বিষয়টি কলেজে গিয়ে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয় মাউশি।
সেই সিদ্ধান্ত মতে, মাউশির কলেজ শাখা দক্ষিণ সুরমা কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানায়, কলেজ শাখার উপপরিচালক ড. আমীর আলী ও সহকারী পরিচালক দেলোয়ার হোসেন পরিদর্শনে যাবেন। যেদিন তারা পরিদর্শনে যাবেন সেদিন সকাল থেকেই অধ্যক্ষ শামসুল ইসলাম কলেজে উপস্থিত ছিলেন। সকাল ৯টা ১০ মিনিটে মাউশির উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক দক্ষিণ সুরমা কলেজে অধ্যক্ষের রুমে ঢুকেই অধ্যক্ষকে গালমন্দ করতে শুরু করেন। অধ্যক্ষের অপরাধ, মাউশির ২ কর্মকর্তার জন্য বিমানের টিকেট কেন করে রাখলেন না, বিমানবন্দরে কলেজ থেকে কেন গাড়ি পাঠালেন না? জানতে চাইলে দক্ষিণ সুরমা কলেজের অধ্যক্ষ শামসুল ইসলাম প্রথমে বিষয়টি স্বীকারই করতে চাননি। পরে তিনি বলেন, আমি ভেবেছি তারা ঢাকা থেকে বাসে আসবেন এবং আমি সেইমতো ব্যবস্থাও নিয়েছি। বিমানে যে আসবেন তারা আমাকে জানাননি, এজন্য আমিও ব্যবস্থা নিতে পারিনি। পুরো বিষয়টি তাদের বুঝিয়ে বলার পর তারা বুঝেছেন। পরে কি বিমানের টিকেট দিতে হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি হেসে দিয়ে বলেন, আপনারা সাংবাদিক-আমি আর কী বলব?
সম্প্রতি জাতীয়করণকৃত জামালপুরের বঙ্গবন্ধু কলেজের সরকারের সঙ্গে ‘ডিড অব গিফ্ট’ শেষ হয়নি। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু কলেজের অধ্যক্ষ ফজলুল হক চৌধুরী শিক্ষকদের কাছ থেকে প্রথম ধাপে জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন। শিক্ষকদের আরো টাকা দিতেও বলেছেন তিনি। পাশর্^বর্তী শেখ কামাল কলেজেও একই অবস্থা।
বারবার চেষ্টা করেও কলেজ দুটোর অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধু কলেজের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, অধ্যক্ষ আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মাউশির কলেজ শাখার উপপরিচালক ড. আমীর আলীকে দিয়েছেন। টাকা দেয়ার সময় কি আপনি উপস্থিত ছিলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অধ্যক্ষ স্যারের ওপর খবরদারি করা যায় না।
লালমনিরহাটের আদিতমারী কলেজ সরকারি হলেও অধ্যক্ষের কাগজপত্র বৈধ নয়। কাগজপত্র বৈধ করতে মাউশির কলেজ শাখাকে দায়িত্ব দিয়েছেন অধ্যক্ষ। এজন্য বেশ খরচাপাতিও করেছেন। জানতে চাইলে আদিতমারি কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, মাউশিতে সব দিয়ে এসেছি। এখন তারা জানে কীভাবে পজেটিভ রিপোর্ট দেবে। একই অবস্থা আরো বহু কলেজের।
এসব বিষয়ে মাউশির কলেজ শাখার উপপরিচালক ড. আমীর আলী বলেন, বিশ্বাস করুন- এসব মিথ্যা কথা। ভিত্তিহীন। বানোয়াট। আমি কোনো ঘুষ নেইনি। ঘুষ নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কাজ না হলেই ওরা মার্কেটে ছড়িয়ে দেয়, ঘুষ নেয়ার বিষয়টি। কীভাবে যে এদের সামলাই-বুঝতে পারছি না। আমি চেষ্টা করেছি, স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে এবং আমি মনে করি, প্রিন্সিপালরা আমার কাজের ওপর সন্তুষ্ট।
ভোরের কাগজ হতে নেয়া