ড. তাহের হত্যা
পরকালে দেখা হবে সন্তানদের নিয়ে বিদেশে চলে যেও
মামুনুর রশিদ/ফরিদপুর প্রতিনিধিঃ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক তাহের হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ড. মিয়া মোঃ মহিউদ্দিনের ফাঁসি আজ রাতে কার্যকর হচ্ছে। স্বজনদের সাথে শেষ সময়ের সাক্ষাতের তিনি নিজেকে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার দাবি করে জীবনের ক্লান্ত পথিকের মত জীবনের অন্তিম মুহূর্তে স্ত্রীকে বলেছেন, দুঃখ করোনা। মনকে শক্ত রেখ। আগামী দিনগুলোতে আমাদের দুটি সন্তান আমানত হিসেবে তোমার কাছে আমি রেখে যাচ্ছি। পরকালে ন্যায় বিচার পাবো! সেদিন তোমাদের সাথে দেখা হবে। শুধু শেষ অনুরধ তোমাদের কাছে!
এদেশে আর থেক না। আমাদের সহায় সম্পত্তি যা কিছু আছে তা বিক্রি করে দিও। ইয়াফি ও ইউসিকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালাম। পরিবারের সদস্যদের সাথে কারাগারে দেখা করতে গিয়ে বিষণ্ণ মনে একথাগুলো শেষ কথা হয় ড. মিয়া মোঃ মহিউদ্দিনের সাথে এমনটি আজকের দর্পণকে জানিয়েছেন তার ছোট ভাই আরজু মিয়া। স্বজনেরা জানান, ফাঁসির শেষ মুহুর্তেও ড. মিয়া মোঃ মহিউদ্দিনের শতবর্ষী বৃদ্ধা মা সেতারা বেগম জানেন না ছেলের আজ রাতেই তার ছেলের ফাঁসির খবর।
প্রসঙ্গত কারণে উল্লেখ্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক তাহের হত্যা মামলার ৪ নম্বর আসামি ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিনের বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার তুজারপুর ইউনিয়নের জান্দি গ্রামে। আজ রাতে তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার খবরে গ্রামের মানুষও বিচলিত। সুশিক্ষিত ও একজন ভাল মানুষ হিসেবেই তারা চিনে এসেছেন এবং জেনে আসছেনমৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিকে।
কথা প্রসঙ্গে তার স্বজনেরা জানান, জান্দি গ্রামে ড. মহিউদ্দিনের পৈত্রিক বাড়িতে বৃদ্ধা মা ব্যতিত তার চাচাতো ভাইয়েরা বসবাস করেন। শতবর্ষী বৃদ্ধা মা একজন শ্রবন প্রতিবন্ধি । তিনি এখনো জানেনই না যে তার ছেলের ফাঁসি হচ্ছে। তাকে কেউ তাকে কিছু জানায়নি। বাড়িতে কোনো সংবাদকর্মী বা কোনো আত্মীয়স্বজনের সমাগম দেখলেই তিনি মা সেতারা বেগম জানতে চাইছেন তার বড় ছেলে মহি উদ্দিন কি বাড়িতে আসবে? গত ১৭ বছর ধরে এভাবে তিনি সময় পার করে আসছেন ছেলের দেখার জন্য। ড. মিয়া মোঃ মহিউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি জান্দি গ্রামে বৃদ্ধ মা ও ছোট ভাই আরজু মিয়া ছাড়াও বোন রিনা বেগম এবং দু’জন চাচাতো ভাই ছিকু মিয়া, শাহীন মিয়া বসবাস করেন। বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় ফাঁসি আজ রাতে কার্যকর খবরে পরিবারের লোকজন স্তব্ধ হয়ে গেছেন।
ছিকু মিয়া (চাচাতো ভাই) জানান, ড. মহিউদ্দিনের সাথে মহিউদ্দিনের স্ত্রী, ভাই আরজু মিয়া, বোন রিনা বেগম, ছিকু মিয়া ও শাহীন মিয়া মঙ্গলবার দুপুরে কারাগারের সেলে গিয়ে শেষ দেখা করে এসেছেন। বেলা ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত তারা একটি ঘণ্টা তারা সেখানে ছিলেন। দুচোখ ছলছলে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন ডঃ অধ্যাপক তাহের ছিলেন আমার বাবার সমতুল্য। নিজের হাতে তিনি আমাকে মানুষ করেছেন। প্রায়ই আমি তার বাসার বাজার ঘাট করে দিতাম। শেষ বারের মত তার সাথে কি কথা হয়েছে বলে জানতে চাইলে ছিকু মিয়া বলেন, বড় ভাই ড. মহিউদ্দিন নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেছেন, হত্যাকাণ্ডে ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। ন্যায় বিচার পেলেন না! আল্লাহর দরবারে বিচার দিয়ে গেলাম? তার স্ত্রীকে বলেছেন, যেহেতু ন্যায় বিচার পেলাম না সেজন্য দুঃখ করে কি হবে-যাকিছু সম্পদ আছে বিক্রি করে দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাওয়ার অনুরধ করেছেন।
ড. মহিউদ্দিনের ছোট ভাই আরজু মিয়া বলেন, আমার ভাই মামলার ৪ নম্বর আসামি ছিলেন। মামলায় প্রথম ও দ্বিতীয় আসামি খালাস পেয়েছেন। অথচ আমার ভাইয়ের ফাঁসি বহাল থাকলো? এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী পরিবারের সন্তান হলেও আমাদেরপরিবারের পাশে ন্যায় বিচারের স্বার্থে কাউকে পেলাম না। আরজু মিয়া বলেন, বড় ভাই নির্দোষ ছিলেন বিধায় মামলা সম্পর্কে তিনি গুরুত্ব দেননি। বড় ভাই বলেছিলেন তিনি কোন অন্যায় করিনি। ইনশাআল্লাহ খালাশ পাবো। রোষানলে পড়ে তার ভাইর ফাঁসি হচ্ছে এমনটি তিনি দাবী করে বলেন পরকালে আমার ভাইর বিচার পাবো আমরা। নিজের মা প্রসঙ্গে তিনি বলেন বড় ভাইয়ের ফাঁসির খবর শুনলে মা স্ট্রক করতে পারেন এ আশঙ্কায় কিছুই জানানো হয়নি গত ১৭ বছরে।
তিনি আরও বলেন, কারা কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে একটা চিঠি দিয়েছিল। সেই চিঠি বাড়ি নিয়ে খুলতে বলেছিলে। আমরা গাড়ির মধ্যেই চিঠি খুলে দেখেছি তাতে লেখা রয়েছে ২৭-৭-২০২৩ বৃহস্পতিবার রাত দশটা এক মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হবে। আমরা লাশ অ্যাম্বুলেন্সে পাঠিয়ে দিব। আপনারা শুধু এম্বুলেন্সের ভাড়া দিয়ে দিয়েন। স্বজনরা জানান, জানাযা বাড়ির মসজিদে এবং জুমার নামাজের আগেই দেয়ার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।
ওই গ্রামের বৃদ্ধা হাসিনা বেগম বলেন, মহিউদ্দিন মিয়াকে আমরা গ্রামে বলি সূর্য মিয়া। তার মত একজন ভদ্র ছেলে আমাদের গ্রামে নাই। গ্রামের আরেক যুবক রনি মিয়া বলেন, আমরা শুনেছি মহিউদ্দিন চাচা জাপান, বেলজিয়াম, অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়াশুনা করে সোনার মেডেল পেয়েছেন। তিনি একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। তার মত এমন মানুষের জন্ম আমাদের এলাকায় আর হবে না।
ব্যক্তি জীবনে ইয়াফি ও ইউসি নামে এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক ড. মিয়া মহিউদ্দিন। তার বাবা মৃত আব্দুল মান্নান মিয়া খুলনা জুট মিলে চাকরি করতেন। ১৯৮১ সালে তিনি ভাঙ্গা কেএম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূতত্ত্ব ও খনিবদ্যা বিষয়ে ভর্তি হন। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন বলে স্বজনেরা জানান।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাবির কোয়ার্টারে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হন অধ্যাপক তাহের। নিহত অধ্যাপক তাহেরের ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। হত্যা মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালত চারজনকে ফাঁসির আদেশ ও দুজনকে খালাস দেন। দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন—একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, নিহত অধ্যাপক ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম, নাজমুল আলম ও আব্দুস সালাম। খালাসপ্রাপ্ত দুজন হলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সী।
২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল মামলায় দুই আসামির ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল এবং অন্য দুই আসামির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন হাইকোর্ট। ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল রাখা দুই আসামি হলেন, অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও নিহত ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম।
ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া দুই আসামি হলেন, নাজমুল আলম ও আব্দুস সালাম। এরপর আসামিরা আপিল বিভাগে আপিল করেন। পাশাপাশি যাবজ্জীবন দণ্ডিত দুই আসামির দণ্ড বাড়াতে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে গত বছরের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রাখেন। ১৫ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়। এরপর মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীর আলম এবং যাবজ্জীবন দণ্ডিত সালাম রিভিউ আবেদন করেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রিভিউয়ের ওপর শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি। আর রায় হয় ২ মার্চ।