শেষ হলো বাঙালির সার্বজনীন দুর্গোৎসব। মঙ্গলবার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ চোখের জলে বিদায় দিয়েছেন জগজ্জননী মা দেবী দুর্গাকে; বিসর্জন দিয়েছেন প্রতিমা। আসছে বছর আবারও এ মর্ত্যলোকে ফিরে আসবেন মা– এমন আকুল প্রার্থনাও তারা করেছেন।
অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ, কল্যাণ ও সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে নিরন্তর শান্তি-সম্প্রীতির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গত শনিবার ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয় এ উৎসব। সনাতন বিশ্বাস ও পঞ্জিকা মতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার ঘোটকে (ঘোড়া) চড়ে স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) এসেছিলেন (আগমন)। দেবী বিদায়ও (গমন) নিয়েছেন ঘোড়ায় চড়ে, যার ফল ছিল শস্যহানি।
দেবী বিসর্জনের দিনটিতে বিষাদের পাশাপাশি উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল পুরো দেশ। হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে উৎসবে যোগ দেন অন্যান্য ধর্মের মানুষও। এবার ঢাকা মহানগরীর ২৪৬টিসহ দেশের ৩২ হাজার ৪০৮টি পূজামণ্ডপে দুর্গোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনসহ বিভিন্ন পূজামণ্ডপে বসে মেলা। পূজা শেষ হলেও কোথাও কোথাও এ মেলা আরও দু-তিন দিন চলবে।
পাঁচ দিনের শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষ দিনের মূল আকর্ষণ ছিল বিজয়া শোভাযাত্রা ও প্রতিমা বিসর্জন। বিকেল ৩টায় ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনের কেন্দ্রীয় পূজামণ্ডপ প্রাঙ্গণ থেকে একযোগে শুরু হয় বর্ণিল শোভাযাত্রা। দুপুর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পূজামণ্ডপ থেকে পূজারিরা ট্রাক ও ঠেলাগাড়িতে করে প্রতিমা নিয়ে সমবেত হন মন্দির মেলাঙ্গনে। সেখানে ভক্তদের নাচ-গানে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। তারা রং ছিটিয়ে, ঢাকঢোলসহ অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি উলুধ্বনিতে উৎসবমুখর করে তোলেন পরিবেশ।
ঢাকেশ্বরী মন্দির পূজামণ্ডপ থেকে রাজঘট ও নবপত্রিকা (কলা বউ) নিয়ে আসার পর শুরু হয় শোভাযাত্রা। পূজা উদযাপন পরিষদ, মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটিসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের নেতৃত্বে শোভাযাত্রায় ট্রাকবাহী প্রতিমাসহ বিচিত্র সাজ পোশাকে সজ্জিত নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর ও যুবকরা হেঁটে ও বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে যোগ দেন। অনেকেই দুর্গা, শিব, মহিষাসুরসহ পৌরাণিক চরিত্রের নানা সাজে অংশ নেন। যাত্রাপথে রাস্তার দু’পাশে এবং আশপাশের ভবনের ছাদ-বারান্দায় দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ শোভাযাত্রাকে স্বাগত জানান।
ঢাকেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পেরিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দোয়েল চত্বর, হাইকোর্ট মাজার, রেলওয়ে হাসপাতাল, নগর ভবন, গোলাপ শাহ মাজার, গুলিস্তান, নবাবপুর রোড ও বাহাদুর শাহ পার্ক হয়ে বুড়িগঙ্গার ওয়াইজঘাটে গিয়ে পৌঁছে। সেখানে ‘দুর্গা মায়ের জয়’, ‘আসছে বছর আবার হবে’ ইত্যাদি ধ্বনি ও উৎসবমুখর পরিবেশে নৌকাগুলো মাঝনদীতে গিয়ে প্রতিমা বিসর্জন দেয়। বিসর্জনের এ পর্ব চলেছে রাত পর্যন্ত। বিসর্জন শেষে শান্তিজল গ্রহণ ও হিন্দুদের ঘরে ঘরে শুভেচ্ছা বিনিময় ও মিষ্টি বিতরণ হয়েছে।
প্রতিমা বিসর্জনের আগে দিনব্যাপী নানা পূজা-অর্চনা চলে। সকাল ৯টা ৫৮ মিনিটের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় দশমীবিহিত পূজা। পূজা শেষে দর্পণ বিসর্জন দেওয়া হয়। চলে ভক্তদের আরতি আর রঙের হোলি খেলা। পরম ভক্তি নিয়ে নিজ নিজ মনের বাসনা জানিয়ে দেবীর পায়ে সিঁদুর ছোঁয়ান নারীরা। এরপর বিসর্জনের জন্য সধবা নারীরা দেবীকে সাজান ফুল, সিঁদুর ও নানা অলংকার দিয়ে। পুরোহিতরা দেবীর জন্য সাজান সেদ্ধ চালের নৈবেদ্য, কচু-ঘেচু, শাপলা দিয়ে। এরপর শেষ মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে বিদায় জানানো হয় দেবীকে।
বিজয়া দশমীকে ঘিরে রাজধানীতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিপুল সংখ্যক পুলিশ-বিজিবি সদস্যের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় র্যাব ও গোয়েন্দা সদস্যদের। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ছিল ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির থেকে শোভাযাত্রার দু’পাশসহ ওয়াইজঘাট পর্যন্ত। দুপুর থেকেই পলাশীর মোড়ের চারপাশে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।