দেলোয়ার হোসেন, ফেনী প্রতিনিধি : ফেনীতে চীন ফেরত বাংলাদেশী ছাত্র ইউনুস বাবু (২৩) হত্যা মামলায় পাঠান বাড়ী এলাকার তাসপিয়া ভবনের কেয়ারটেকার মোজাম্মেল হক শাহীনের ৭দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ফেনী শহর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সুদ্বীপ রায় সোমবার (১২ অক্টোবর) দুপুরে তার ১০দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন তার ৭দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এসময় আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ইঞ্জিনিয়ার বাবুকে হত্যার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়, ইঞ্জিনিয়ার বাবুর বন্ধু পূর্ব বিরোধের জেরে ডেকে এনে শাহীন ও তার বন্ধু রাকিব সহ তাদের সহযোগিরা হত্যার উদ্দেশ্যে এলোপাথাড়ি কোপানো হয়। এসময় বাবু এগিয়ে এসে বাধা দিলে তাকেও কুপিয়ে হত্যা করে দুইজনকে হাত-পা বেধে সেফটিক ট্যাংকে ফেলে দেয়া হয়। ফেনী জজ কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ আবুল হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ১০ অক্টোবর শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে ফেনী শহরের শফিকুর রহমান সড়কের তাসপিয়া ভবনের সেফটিক ট্যাংক থেকে ইঞ্জিনিয়ার বাবুর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
নিহত ইউনুস বাবু সোনাগাজীর বগাদানা ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের সওদাগর বাড়ির মো. আবু ইউছুপের ছেলে। বাবু ফেনী আইসিএসটি থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে স্কলারশিপ নিয়ে দেড় বছর যাবৎ চীনের আহট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। নিহত বাবুর মা রেজিয়া বেগম জানান, করোনাকালীন সময়ে ছেলে দেশে এসে বাবা-মায়ের সঙ্গে ফেনী শহরের একটি বাসায় থাকত। তার নানা বাড়ি সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের চরসোনাপুর তিনবাড়িয়া গ্রামে। ২০১৩ সালে সোনাগাজী আল হেলাল একাডেমি থেকে বাবু এসএসসি পাস করেছিল। গত ৮ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে বন্ধু ইউনুস নবী রাকিব ও শাহরিয়ার বাবুকে বাসা থেকে ডেকে এনেছিল।
একই দিন ভোর ৪টার দিকে তাসপিয়া ভবনের মালিকের স্ত্রী তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য উঠলে সেফটিক ট্যাংকের ভেতর থেকে আল্লাহ আমাকে বাঁচাও ডাক শুনতে পান। এসময় তিনি আরো দেখতে পান বাড়ির কেয়ারটেকার তার ভাগ্নে মোজাম্মেল হক শাহীন মেঝেতে পড়ে থাকা রক্ত পরিস্কার করছেন। তাৎক্ষণিক বিষয়টি তার কাছে সন্দেহ জনক মনে হলে কেয়ারটেকারকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন। সেই একই সেফটিক ট্যাংক থেকে অজ্ঞান অবস্থায় বাবুর বন্ধু শাহরিয়ারকে উদ্ধার করা হয়। গলা কাটা সহ তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাথাড়ি কোপের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শাহরিয়ার ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নের আমানউদ্দিন ভূঁঞা বাড়ির কামাল উদ্দিনের ছেলে। তাকে প্রথমে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে ও পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তার সামান্য জ্ঞান ফিরলে বন্ধু বাবুকে খুঁজতে থাকে।
এদিকে বাবুর মা বন্ধু ইউনুস নবী রাকিবকে নিয়ে একাধিকবার থানায় গিয়ে এস আই বিকাশ দাসের সাথে আলোচনা করেন এবং সেফটিক ট্যাংকে তল্লাশী চালাতে বলেন। তিনি সেফটিক ট্যাংকে তল্লাশীতে অনিহা প্রকাশ করে শাহরিয়ারকে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় বাবু জড়িত আখ্যা দিয়ে তাকে উল্টো ভয় দেখান এবং তার ছেলে শাহরিয়ারকে হত্যা চেষ্টা মামলার আসামি করা হয়। ওই মামলায় কেয়ারটেকার মোজাম্মেল হক শাহীনকে গ্রেফতার দেখিয়ে ফেনীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বাবু ও সে সহ শাহরিয়ারকে হত্যা চেষ্টার স্বীকারোক্তিও আদায় করা হয়। শাহরিয়ারের জ্ঞান ফিরলে বাবুকে খোঁজার রহস্য জানতে বাবুর মা গাগলপ্রায় হয়ে এক পর্যায়ে নিজে ও তার স্বামী নেমে হলেও সেফটিক ট্যাংক তল্লাশী করার জন্য দিনভর বাড়িওয়ালী ও ফেনী থানার এসআই বিকাশ দাসের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন। ইউনুস নবী রাকিব ওই পুলিশ কর্মকর্তার সাথে দিনভর আড্ডা দিলেও রহস্যজনক কারণে তিনি তাকে আটক বা গ্রেপ্তার করেননি।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে বাড়িওয়ালীর অনুমতি নিয়ে বাবুর মা-বাবা সেফটিক ট্যাংকের তালা ভেঙে টর্চ লাইট মেরে তল্লাশী করলে প্লাস্টিকের পলিথিন মোড়ানো কি যেন দেখতে পেয়ে পূনরায় থানা পুলিশকে ঘটনাস্থলে নেন। ফায়ার সার্ভিসের দল ও পুলিশ স্থানীয় জনতা চেষ্টা চালিয়ে শনিবার দিবাগত রাত সর্বশেষ একটার দিকে বাবুর মরদেহ উদ্ধার করে। এ ফাঁকে তার বন্ধু রাকিব আত্মগোপনে চলে যায়। এঘটনায় ফেনী পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের কদলগাজী তেমুহনীর রেনু হাজারী বাড়ির নূর আলম রাকিব ও তাসপিয়া ভবনের কেয়ারটেকার দাগনভূঁঞা উপজেলার দক্ষিণ জায়লস্কর গ্রামের ফকির হাফেজ বাড়ির মো. সেলিমের ছেলে মোজাম্মেল হক শাহীনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ৪-৫জনকে আসামি করে ফেনী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
রাকিব ফেনী পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি। বাবুর মা রেজিয়া বেগমের ধারণা বাবুর কাছে একটি দামী আইফোন এবং তার বন্ধু শাহরিয়ার কাছে থাকা মোটরসাইকেল আত্মসাৎ করতে বাবু ও শাহরিয়ারকে পরিকল্পিতভাবে উপর্যুপরি কুপিয়ে সেফটিক ট্যাংকে ফেলা হয়েছে। তিনি দ্রুত রাকিবকে আইনের আওতায় এনে হত্যা ও হত্যা রহস্য উন্মোচন করে ন্যায় বিচারের দাবি জানান। এদিকে বাবুর মায়ের আহাজারি কোন ভাবেই থামাতে পারছেননা আত্মীয়-স্বজনরা। তিনি প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে বার বার মুর্ছা যাচ্ছেন। জ্ঞান ফিরলেই শুধু বাবুকে খুঁজছেন।
বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোকচিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বেআইনি।