ঢাকা ১২:২৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নবীজির প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা

Rayhan Zaman
  • আপডেট সময় : ১০:১০:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / ১০১১ বার পড়া হয়েছে

নবীর প্রতি ভালোবাসা এবং নবী-আদর্শের প্রতি আস্থার সবক নিতে আমাদেরকে হাজির হতে হবে সাহাবীগণের দরবারে। কেননা তাঁদের এই প্রেম ও আস্থার আর কোনো নজির নেই। রোম সম্রাটের হাতে বন্দী সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে হুযাফা (রা.)। একান্তে ডেকে সম্রাট এ প্রলোভন দিলো যে, ‘খ্রীষ্টান হয়ে যাও। প্রতিদানে আমার এ বিশাল ভূখ-ের অর্ধেক তুমি পাবে।’ ইবনে হুযাফার মনে সামান্য চাঞ্চল্যও সৃষ্টি হলো না।

তিনি স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিলেনÑ ‘অর্ধেক রাজত্ব নয়, তোমার পুরো রাজত্ব এবং তার সাথে বিশাল আরব সাম্রাজ্যও যদি আমার হাতের মুঠোয় ভরে দেয়া হয় তবুও এক পলকের জন্য মুহাম্মাদ (সা.)-এর আনীত দ্বীন হতে বিচ্যুত হবো না। অতঃপর একটি বিশাল পাত্রে প্রচ-ভাবে পানি ফুটানো হলো। ইবনে হুযাফার চোখের সামনে একে একে দু’জন মুসলিম কয়েদীকে নির্মমভাবে পানিতে নিক্ষেপ করে শহীদ করা হলো। তাদের পরিণতি দেখিয়ে পুনরায় তাকে খ্রীষ্টধর্ম কবুলের ফুরসত দেয়া হলো। আগের মতোই তা প্রত্যাখ্যান করলেন।

এবার তাকে ফুটন্ত পানিতে নিক্ষেপ করার আদেশ দেয়া হলো। ডেগচির সামনে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মৃদু কাঁদলেন। সম্রাট ভাবল, সে হয়তো দুর্বল হয়েছে। কাছে ডেকে আবারো খ্রীষ্টধর্ম পেশ করা হলো। কিন্তু এবারো তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। সম্রাট প্রশ্ন করল, তাহলে তুমি কাঁদলে কেন? ইবনে হুযাফা (রা.) বললেন, ডেগের কাছাকাছি যাওয়ার পর আমি ভাবলাম, হায়! কিছুক্ষণ পরই আমার প্রাণপাখি উড়ে যাবে। হায়! আমার শরীরে যতগুলো লোম আছে সে পরিমাণ প্রাণ যদি আমার থাকত তবে একে একে সবগুলোই আমি আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করতাম। এ ভাবনা আসতেই আমার দু’চোখ ভিজে উঠেছিল। (ইসাবা-৪/৫৯)

এক সাহাবী নবীজির দরবারে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকে আমি নিজের চেয়ে এবং নিজ সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। বাড়িতে গেলে আপনার কথা মনে পড়লে সহ্য করতে পারি না। বেচাইন হয়ে পড়ি। এসে আপনাকে এক পলক দেখে যাই। কিন্তু মৃত্যুর কথা মনে হলে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। আমি ভাবি, জান্নাতের অত্যুচ্চ মাকামে নবীদের সাথে আপনি থাকবেন। তখন কি আপনাকে এভাবে এক পলক দেখে যাওয়ার সুযোগ পাব? শুনে নবীজী চুপ করে রইলেন।

ইতোমধ্যে আসমানী বার্তা নিয়ে জিবরাঈল (আ.) উপস্থিত হলেনÑ ‘যে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে সে নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং সৎকর্ম পরায়নদের সঙ্গে থাকবে। (তবারানী, আওসাত-৪৬০)
এক আগন্তুক এসে জিজ্ঞাসা করল, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? নবীজী বললেন, তুমি তার জন্য কী প্রস্তুতি নিয়েছ? আগন্তুক বলল, কোনো প্রস্তুতি নিতে পারিনি তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি। নবীজী বললেন, তুমি তোমার প্রেমাষ্পদের সাথেই থাকবে। হযরত আনাস (রা.) বলেন, এ কথা শুনে আমরা এতো বেশি আনন্দিত হয়েছি, যা ইতোপূর্বে আর কোনোদিন হইনি। (সহিহ বুখারী-৩৬৮৮)

প্রশ্ন জাগে, কিসের লোভে আশিটিরও বেশি তীর তার তরবারির আঘাত নিয়ে উহুদের মাঠে কাতরাচ্ছিলেন হযরত আনাস বিন নযর (রা.)। কার প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে শত্রট্টর হাতে কুচি কুমি হওয়া হযরত হামযা (রা.)-এর দেহটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল উহুদ প্রান্তরে? কত ইতিহাস লেখা হলো, কত উপাখ্যান রচিত হলো, কিন্তু আনুগত্যের এ ইতিহাস এবং ভালোবাসার এ উপাখ্যান আজও অতুলনীয়ই থেকে গেল। তাদের এ বাস্তব কাহিনী রূপকথাকেও হার মানিয়েছে। মক্কার কাফেরদের হাতে বন্দী হলেন সাহাবী হযরত খুবাইব (রা.)।

বদর যুদ্ধে নিহতদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা তাকে শূলিতে চড়াল। কাফেরদের নিক্ষিপ্ত তীরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তার শরীর। এ সময় তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তোমার স্থানে আজ মুহাম্মাদকে এনে দিলে কি তুমি খুশি হবে? শুনে হযরত খুবাইব (রা.)-এর রক্ত কণিকায় শিহরণ জেগে উঠে। শূলীকাষ্ঠে আবদ্ধ অবস্থায় তিনি বলে উঠলেন, খোদার কসম! কক্ষনো নয়। তাঁর গায়ে একটি কাঁটার আঁচড় লাগুক তাও আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। অতঃপর তার গলে যখন ফাঁসির দড়ি পরানো হচ্ছিল তিনি কবিতা বললেন।

যার অর্থ হলোÑ ‘প্রভু হে আমার, তোমাকেই বলি আমার দুঃখ জ্বালা/তুমিই দেখছ মুশরিকদের এই মিলিত তা-বলীলা। তোমার পথে নিজেকে আজি করে দিলাম কুরবান, ছিন্ন দেহের প্রতিটি অঙ্গের তুমি দিও প্রতিদান। যেখানেই মরি, যেভাবেই মরি, চিন্তা কিসের আমার/আমি মুসলিম, সৈনিক আমি শুধু এক আল্লাহর।’ (তবারানী, কাবীরÑ৫/২৫৯-২৬৬)

এমন অকৃত্রিম ভালোবাসা আর অসীম আত্মত্যাগ দেখে তৎকালীন মুশরিকদের সর্দার আবু সুফিয়ান স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, মুহাম্মাদের সাহাবীরা তাকে যতো ভালোবাসে, কেউ কাউকে এতে বেশি ভালোবাসতে আমি দেখিনি। (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া-৩/২০৬)

ট্যাগস :

নবীজির প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসা

আপডেট সময় : ১০:১০:৫৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

নবীর প্রতি ভালোবাসা এবং নবী-আদর্শের প্রতি আস্থার সবক নিতে আমাদেরকে হাজির হতে হবে সাহাবীগণের দরবারে। কেননা তাঁদের এই প্রেম ও আস্থার আর কোনো নজির নেই। রোম সম্রাটের হাতে বন্দী সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে হুযাফা (রা.)। একান্তে ডেকে সম্রাট এ প্রলোভন দিলো যে, ‘খ্রীষ্টান হয়ে যাও। প্রতিদানে আমার এ বিশাল ভূখ-ের অর্ধেক তুমি পাবে।’ ইবনে হুযাফার মনে সামান্য চাঞ্চল্যও সৃষ্টি হলো না।

তিনি স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিলেনÑ ‘অর্ধেক রাজত্ব নয়, তোমার পুরো রাজত্ব এবং তার সাথে বিশাল আরব সাম্রাজ্যও যদি আমার হাতের মুঠোয় ভরে দেয়া হয় তবুও এক পলকের জন্য মুহাম্মাদ (সা.)-এর আনীত দ্বীন হতে বিচ্যুত হবো না। অতঃপর একটি বিশাল পাত্রে প্রচ-ভাবে পানি ফুটানো হলো। ইবনে হুযাফার চোখের সামনে একে একে দু’জন মুসলিম কয়েদীকে নির্মমভাবে পানিতে নিক্ষেপ করে শহীদ করা হলো। তাদের পরিণতি দেখিয়ে পুনরায় তাকে খ্রীষ্টধর্ম কবুলের ফুরসত দেয়া হলো। আগের মতোই তা প্রত্যাখ্যান করলেন।

এবার তাকে ফুটন্ত পানিতে নিক্ষেপ করার আদেশ দেয়া হলো। ডেগচির সামনে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মৃদু কাঁদলেন। সম্রাট ভাবল, সে হয়তো দুর্বল হয়েছে। কাছে ডেকে আবারো খ্রীষ্টধর্ম পেশ করা হলো। কিন্তু এবারো তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন। সম্রাট প্রশ্ন করল, তাহলে তুমি কাঁদলে কেন? ইবনে হুযাফা (রা.) বললেন, ডেগের কাছাকাছি যাওয়ার পর আমি ভাবলাম, হায়! কিছুক্ষণ পরই আমার প্রাণপাখি উড়ে যাবে। হায়! আমার শরীরে যতগুলো লোম আছে সে পরিমাণ প্রাণ যদি আমার থাকত তবে একে একে সবগুলোই আমি আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করতাম। এ ভাবনা আসতেই আমার দু’চোখ ভিজে উঠেছিল। (ইসাবা-৪/৫৯)

এক সাহাবী নবীজির দরবারে এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকে আমি নিজের চেয়ে এবং নিজ সন্তানের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। বাড়িতে গেলে আপনার কথা মনে পড়লে সহ্য করতে পারি না। বেচাইন হয়ে পড়ি। এসে আপনাকে এক পলক দেখে যাই। কিন্তু মৃত্যুর কথা মনে হলে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। আমি ভাবি, জান্নাতের অত্যুচ্চ মাকামে নবীদের সাথে আপনি থাকবেন। তখন কি আপনাকে এভাবে এক পলক দেখে যাওয়ার সুযোগ পাব? শুনে নবীজী চুপ করে রইলেন।

ইতোমধ্যে আসমানী বার্তা নিয়ে জিবরাঈল (আ.) উপস্থিত হলেনÑ ‘যে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে সে নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং সৎকর্ম পরায়নদের সঙ্গে থাকবে। (তবারানী, আওসাত-৪৬০)
এক আগন্তুক এসে জিজ্ঞাসা করল, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? নবীজী বললেন, তুমি তার জন্য কী প্রস্তুতি নিয়েছ? আগন্তুক বলল, কোনো প্রস্তুতি নিতে পারিনি তবে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি। নবীজী বললেন, তুমি তোমার প্রেমাষ্পদের সাথেই থাকবে। হযরত আনাস (রা.) বলেন, এ কথা শুনে আমরা এতো বেশি আনন্দিত হয়েছি, যা ইতোপূর্বে আর কোনোদিন হইনি। (সহিহ বুখারী-৩৬৮৮)

প্রশ্ন জাগে, কিসের লোভে আশিটিরও বেশি তীর তার তরবারির আঘাত নিয়ে উহুদের মাঠে কাতরাচ্ছিলেন হযরত আনাস বিন নযর (রা.)। কার প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে শত্রট্টর হাতে কুচি কুমি হওয়া হযরত হামযা (রা.)-এর দেহটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল উহুদ প্রান্তরে? কত ইতিহাস লেখা হলো, কত উপাখ্যান রচিত হলো, কিন্তু আনুগত্যের এ ইতিহাস এবং ভালোবাসার এ উপাখ্যান আজও অতুলনীয়ই থেকে গেল। তাদের এ বাস্তব কাহিনী রূপকথাকেও হার মানিয়েছে। মক্কার কাফেরদের হাতে বন্দী হলেন সাহাবী হযরত খুবাইব (রা.)।

বদর যুদ্ধে নিহতদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে তারা তাকে শূলিতে চড়াল। কাফেরদের নিক্ষিপ্ত তীরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তার শরীর। এ সময় তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তোমার স্থানে আজ মুহাম্মাদকে এনে দিলে কি তুমি খুশি হবে? শুনে হযরত খুবাইব (রা.)-এর রক্ত কণিকায় শিহরণ জেগে উঠে। শূলীকাষ্ঠে আবদ্ধ অবস্থায় তিনি বলে উঠলেন, খোদার কসম! কক্ষনো নয়। তাঁর গায়ে একটি কাঁটার আঁচড় লাগুক তাও আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। অতঃপর তার গলে যখন ফাঁসির দড়ি পরানো হচ্ছিল তিনি কবিতা বললেন।

যার অর্থ হলোÑ ‘প্রভু হে আমার, তোমাকেই বলি আমার দুঃখ জ্বালা/তুমিই দেখছ মুশরিকদের এই মিলিত তা-বলীলা। তোমার পথে নিজেকে আজি করে দিলাম কুরবান, ছিন্ন দেহের প্রতিটি অঙ্গের তুমি দিও প্রতিদান। যেখানেই মরি, যেভাবেই মরি, চিন্তা কিসের আমার/আমি মুসলিম, সৈনিক আমি শুধু এক আল্লাহর।’ (তবারানী, কাবীরÑ৫/২৫৯-২৬৬)

এমন অকৃত্রিম ভালোবাসা আর অসীম আত্মত্যাগ দেখে তৎকালীন মুশরিকদের সর্দার আবু সুফিয়ান স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, মুহাম্মাদের সাহাবীরা তাকে যতো ভালোবাসে, কেউ কাউকে এতে বেশি ভালোবাসতে আমি দেখিনি। (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া-৩/২০৬)