ঢাকা ০৫:৫৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৮ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম:
Logo তাড়াইলে ধলা ইউপি চেয়ারম্যান ঝিনুক গ্রেফতার Logo কিশোরগঞ্জে চবি চাকসুর জিএস সাঈদ বিন হাবিবকে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা Logo কিশোরগঞ্জে জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খানের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত Logo খাগড়াছড়িতে আ.লীগের মিছিল: সাবেক প্রতিমন্ত্রীসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা Logo প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার Logo রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ Logo নভেম্বরের ৯ দিনে রেমিট্যান্স প্রবাহে ৪৮.৭ শতাংশ বৃদ্ধি Logo ত্যাগ, নৈতিকতা নাকি দলীয় বলয়; কিশোরগঞ্জের ফাঁকা দুই আসনে কোন পথ বেছে নেবে রাজনীতি? Logo নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র: ক্ষমতার লোভে পেয়েছে উপদেষ্টাদের Logo খাগড়াছড়ি কারাগার থেকে পালিয়েছে দুই আসামি

বড়ইতলা স্মৃতিসৌধে নেমে এসেছে নীরবতা, হারিয়ে গেছে শ্রদ্ধা!

Doinik Astha
Doinik Astha
  • আপডেট সময় : ০৩:৪২:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫
  • / ১২০৩ বার পড়া হয়েছে

একসময় ১৩ অক্টোবরের সকাল মানেই কিশোরগঞ্জের কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বড়ইতলা স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল। ফুলের তোড়া হাতে হাজির হতেন প্রশাসনের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসতেন মুক্তিযোদ্ধা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। কিন্তু এখন সেই চিত্র উল্টো। এ বছর শহীদদের স্মরণে আয়োজিত দিবসে বড়ইতলা স্মৃতিসৌধে ছিল না প্রশাসনের কোনো প্রতিনিধি, না ছিল রাজনৈতিক কোনো নেতার উপস্থিতি। ধুলোয় ঢাকা স্মৃতিফলক, ফাটা দেয়াল, আগাছায় ঘেরা প্রাঙ্গণ যেন নির্বাক ভাষায় বলছে,  ভুলে গেছে সবাই?

সোমবার (১৩ অক্টোবর) সকালে শহীদ পরিবারের কয়েকজন সদস্য ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই ফুল দিয়ে শহীদদের স্মরণ করে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া করে কেঁদেছেন নীরবে।

শহীদ পরিবারের সদস্য আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আজিজুল হক মিয়া বলেন, প্রতি বছর আমরা অপেক্ষায় থাকি কেউ আসবে শহীদদের স্মরণে। কিন্তু এখন মনে হয় শহীদদের কেউ আর মনে রাখে না। প্রশাসনের কেউ আসে না, রাজনীতিবিদরা তো দূরের কথা।

যশোদল ইউনিয়নের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার বিরোধীরা এখনও স্বাধীনতার পক্ষকে নির্মূল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা বড়ইতলার ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করছে; কিন্তু বাংলাদেশ এবং মুক্তিযোদ্ধারা যতদিন থাকবে, তাদের সেই আশা পূরণ হবে না। আমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাব।

বাম রাজনৈতিক নেতা আব্দুর রহমান রুমী বলেন, বড়ইতলার মাটিতে যেই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তার সমর্থকরা আজও দেশের মধ্যে আছে। আমরা তদন্তের ভিত্তিতে তাদের বিচার দাবি করছি। বারবার এই হত্যাকাণ্ড ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তবুও আমরা আমাদের স্বজনদের হত্যাকাণ্ড কখনও ভুলবো না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই কাহিনি ছড়িয়ে দেব। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র ও সাম্যের চেতনা বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের অঙ্গীকার।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে কিশোরগঞ্জ থেকে ট্রেনে করে বড়ইতলায় আসে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর, আলশামসরা। পাশের দামপাড়া গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে চার-পাঁচজন নিরীহ গ্রামবাসীকে। আতঙ্কে আশপাশের গ্রামগুলো ফাঁকা হয়ে যায়।

পরে রাজাকাররা সভা হবে বলে গ্রামবাসীকে ডেকে নেয় বড়ইতলায়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য চলাকালে ছড়িয়ে পড়ে গুজব। স্থানীয়রা নাকি দুই পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করেছে। আর সেই গুজবের জেরেই শুরু হয় এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। রেললাইনের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ৩৬৫ নিরীহ মানুষকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বড়ইতলা গ্রাম পরিণত হয় লাশের স্তূপে।

স্বাধীনতার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম গণহত্যাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে বড়ইতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শহীদনগর’। ২০০০ সালে রেললাইনের পাশে নির্মিত হয় ২৫ ফুট উচ্চতার স্মৃতিসৌধ।

কিন্তু আজ সেই স্মৃতিসৌধ পড়ে আছে অবহেলায়। চারপাশে আগাছা, দেয়াল ফাটা, শহীদদের নাম লেখা ফলকও মলিন হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা যোবায়ের আহমাদ বলেন, বছরে একদিন প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের দেখা মিলত, এখন তাও নেই। স্মৃতিসৌধের চারপাশে ঘাসে ভরে গেছে, কেউ খোঁজ নেয় না।

শহীদ পরিবারের আরেক সদস্য আব্দুস সালাম চোখ মুছে বলেন, আমার বাবা শহীদ হয়েছেন এই মাটিতে। আমরা গর্বিত, কিন্তু কষ্টও হয় এখন আর কেউ আসে না, কেউ খোঁজ নেয় না। মনে হয় শহীদদের রক্তের ইতিহাসও মুছে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুল হাসান মারুফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা ও ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বড়ইতলার বাতাসে ভাসে সেই দিনের হাহাকার। রেললাইনের পাশে দাঁড়ালে মনে হয়, এই মাটিতেই কেউ একদিন শেষ চিৎকারে বলেছিল জয় বাংলা! তারপর নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সবকিছু।

এখন শহীদ পরিবারের মানুষের একটিই প্রত্যাশা স্মৃতিসৌধে নিয়মিত পরিচর্যা হোক, প্রশাসন ও সমাজের মানুষ যেন অন্তত একদিন এই বীর শহীদদের স্মরণে ফুল হাতে আসে।

বড়ইতলা স্মৃতিসৌধে নেমে এসেছে নীরবতা, হারিয়ে গেছে শ্রদ্ধা!

আপডেট সময় : ০৩:৪২:৩৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

একসময় ১৩ অক্টোবরের সকাল মানেই কিশোরগঞ্জের কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বড়ইতলা স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল। ফুলের তোড়া হাতে হাজির হতেন প্রশাসনের কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসতেন মুক্তিযোদ্ধা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। কিন্তু এখন সেই চিত্র উল্টো। এ বছর শহীদদের স্মরণে আয়োজিত দিবসে বড়ইতলা স্মৃতিসৌধে ছিল না প্রশাসনের কোনো প্রতিনিধি, না ছিল রাজনৈতিক কোনো নেতার উপস্থিতি। ধুলোয় ঢাকা স্মৃতিফলক, ফাটা দেয়াল, আগাছায় ঘেরা প্রাঙ্গণ যেন নির্বাক ভাষায় বলছে,  ভুলে গেছে সবাই?

সোমবার (১৩ অক্টোবর) সকালে শহীদ পরিবারের কয়েকজন সদস্য ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই ফুল দিয়ে শহীদদের স্মরণ করে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া করে কেঁদেছেন নীরবে।

শহীদ পরিবারের সদস্য আজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আজিজুল হক মিয়া বলেন, প্রতি বছর আমরা অপেক্ষায় থাকি কেউ আসবে শহীদদের স্মরণে। কিন্তু এখন মনে হয় শহীদদের কেউ আর মনে রাখে না। প্রশাসনের কেউ আসে না, রাজনীতিবিদরা তো দূরের কথা।

যশোদল ইউনিয়নের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার বিরোধীরা এখনও স্বাধীনতার পক্ষকে নির্মূল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা বড়ইতলার ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করছে; কিন্তু বাংলাদেশ এবং মুক্তিযোদ্ধারা যতদিন থাকবে, তাদের সেই আশা পূরণ হবে না। আমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাব।

বাম রাজনৈতিক নেতা আব্দুর রহমান রুমী বলেন, বড়ইতলার মাটিতে যেই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তার সমর্থকরা আজও দেশের মধ্যে আছে। আমরা তদন্তের ভিত্তিতে তাদের বিচার দাবি করছি। বারবার এই হত্যাকাণ্ড ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তবুও আমরা আমাদের স্বজনদের হত্যাকাণ্ড কখনও ভুলবো না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই কাহিনি ছড়িয়ে দেব। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র ও সাম্যের চেতনা বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের অঙ্গীকার।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে কিশোরগঞ্জ থেকে ট্রেনে করে বড়ইতলায় আসে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর, আলশামসরা। পাশের দামপাড়া গ্রামে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে চার-পাঁচজন নিরীহ গ্রামবাসীকে। আতঙ্কে আশপাশের গ্রামগুলো ফাঁকা হয়ে যায়।

পরে রাজাকাররা সভা হবে বলে গ্রামবাসীকে ডেকে নেয় বড়ইতলায়। সেখানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য চলাকালে ছড়িয়ে পড়ে গুজব। স্থানীয়রা নাকি দুই পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করেছে। আর সেই গুজবের জেরেই শুরু হয় এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। রেললাইনের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ৩৬৫ নিরীহ মানুষকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বড়ইতলা গ্রাম পরিণত হয় লাশের স্তূপে।

স্বাধীনতার পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম গণহত্যাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে বড়ইতলার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শহীদনগর’। ২০০০ সালে রেললাইনের পাশে নির্মিত হয় ২৫ ফুট উচ্চতার স্মৃতিসৌধ।

কিন্তু আজ সেই স্মৃতিসৌধ পড়ে আছে অবহেলায়। চারপাশে আগাছা, দেয়াল ফাটা, শহীদদের নাম লেখা ফলকও মলিন হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা যোবায়ের আহমাদ বলেন, বছরে একদিন প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিদের দেখা মিলত, এখন তাও নেই। স্মৃতিসৌধের চারপাশে ঘাসে ভরে গেছে, কেউ খোঁজ নেয় না।

শহীদ পরিবারের আরেক সদস্য আব্দুস সালাম চোখ মুছে বলেন, আমার বাবা শহীদ হয়েছেন এই মাটিতে। আমরা গর্বিত, কিন্তু কষ্টও হয় এখন আর কেউ আসে না, কেউ খোঁজ নেয় না। মনে হয় শহীদদের রক্তের ইতিহাসও মুছে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুল হাসান মারুফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা ও ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বড়ইতলার বাতাসে ভাসে সেই দিনের হাহাকার। রেললাইনের পাশে দাঁড়ালে মনে হয়, এই মাটিতেই কেউ একদিন শেষ চিৎকারে বলেছিল জয় বাংলা! তারপর নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সবকিছু।

এখন শহীদ পরিবারের মানুষের একটিই প্রত্যাশা স্মৃতিসৌধে নিয়মিত পরিচর্যা হোক, প্রশাসন ও সমাজের মানুষ যেন অন্তত একদিন এই বীর শহীদদের স্মরণে ফুল হাতে আসে।