সূরা হুজুরাতের ১২নং আয়াতটি একটি প্রসিদ্ধ আয়াত। এ আয়াতে মৌলিকভাবে তিনটি বিষয় থেকে বেঁচে থাকার আদেশ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, হে ঈমানদারগণ! বেঁচে থাক বহু ধারণা থেকে। নিশ্চয়ই কিছু ধারণা গোনাহ। আর (একে অন্যের পিছনে) অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়ো না। আর একে অন্যের গীবত করো না। তোমাদের কেউই কি পছন্দ করবে। নিজ মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে? নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে তা অপছন্দের। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
যে তিন বিষয় থেকে এ আয়াতে বেঁচে থাকতে বলা হয়েছে তার প্রথমটি হচ্ছে ‘যন’ বা ধারণা। আমরা জানি যে, ধারণা দুই রকমের হয় : প্রমাণভিত্তিক ধারণা ও প্রমাণহীন ধারণা। বিভিন্ন কারণে মানুষের মনে ধারণা জাগে। সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয় থেকেও ধারণার সৃষ্টি হয়। অজ্ঞতার কারণে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়। যা ‘কারণ’ নয় তাকে ‘কারণ’ মনে করার ফলে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়। দু’-একটি উদাহরণ দেয়া যাক।
সূরা হজ্বে আল্লাহ তায়ালা একশ্রেণির লোকের কথা বলেছেন : আর কোনো কোনো মানুষ আল্লাহর ইবাদত করে কিনারায় দাঁড়িয়ে, অতঃপর তার যদি কোনো (পার্থিব) স্বার্থ লাভ হয় তবে সে এর দ্বারা আশ্বস্ত হয়। আর যদি কোনো (পরীক্ষাগত) বিপদ আসে তবে সে ঊর্ধ্ব মুখে ফিরে যায়। সে দুনিয়া আখেরাত দুইই হারায়। এ-ই তো স্পষ্ট ক্ষতি। (সূরা হজ্ব : ১১)।
এ আয়াতের প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, কিছু লোক এমন ছিল যারা মদীনায় আসার পর কিছু পার্থিব প্রাপ্তি যোগ হলে, যেমন, স্ত্রী-পুত্র-সন্তান হলে বা ঘোড়া শাবক প্রসব করলে, বলত ‘এই ধর্ম ভালো’! আর এমন কিছু না হলে বলত ‘এই ধর্ম ভালো না’! (এ জাতীয় লোকের কথা এ আয়াতে বলা হয়েছে।) (সহীহ বুখারী : ৪৭৪২)। তো এই যে ধারণা, ধর্ম-বিচারের এই যে মানদ- এ তো চূড়ান্ত অজ্ঞতা। দ্বীন বা আদর্শের সত্যাসত্যের মানদ- কি গ্রহণকারীর মনোবাঞ্ছা পূরণ হওয়া বা না-হওয়া দ্বীন বা আদর্শের মানদ- তো তার শিক্ষার যথার্থতা।
ইসলাম তো তার অনুসারীদের এ প্রতিশ্রুতি দেয়নি যে, ইসলাম গ্রহণ করলে তোমার সব ইচ্ছা পূরণ হবে, পার্থিব স্বার্থসিদ্ধি হবে, দুনিয়াতে যা চাবে তাই পাবে! বরং ইসলাম মানুষকে প্রতিশ্রুতি দেয় আখিরাতের নাজাতের আর দুনিয়াতে ঈমান-ইয়াকীন ও তায়াক্কুলের স্তর অনুপাতে মানসিক শান্তি ও প্রশান্তির, খাইর ও বরকতের। তাহলে মনের কোনো একটি ইচ্ছা পূরণ না হলেই এ ধারণা করা যে, ‘এ দ্বীন সত্য নয়’ (নাউযুবিল্লাহ) এক ভিত্তিহীন ও অবান্তর ধারণা।
এ জাতীয় ভিত্তিহীন-অপ্রাসঙ্গিক ধারণা এ যুগের কোনো কোনো মুসলমানের মধ্যেও দেখা যায়। অনেককে এ ধরনের ঘটনা বলতে শোনা যায় যে, ‘অমুকের বড় সমস্যা ছিল, অমুকের ছেলে খুব অসুস্থ ছিল, অনেক চেষ্টা-তদবীর, অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দ্বারাও সমাধান হলো না। এরপর অমুক (ভ-) ফকীরের কাছে যাওয়ার পর ছেলে সুস্থ হয়েছে, সমস্যার সমাধান হয়েছে! সুতরাং ওই লোক সহীহ লোক! ইত্যাদি।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ সকল ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষী পাওয়া যায় না। শুধু বলে, অমুকে বলেছে। অমুকের কাছে শুনেছি। আর কোনো সময় যদি ঘটনাচক্রে সুস্থতা বা সমাধান হয় তাহলে তা আল্লাহর ফয়সালায় হয়েছে। এর দ্বারা কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত ভ-ামীগুলো সহীহ হয়ে যায় কীভাবে? কিন্তু অনেক মানুষ অজ্ঞতার কারণে এবং ঈমানী দুর্বলতার কারণে সুস্থতা ও সমাধানকে ওই ভ-ের বা ভ-ামীর অবদান মনে করে। এটা ভুল ধারণা, ভিত্তিহীন ধারণা।
তাহলে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বিষয় থেকেও মানুষের মনে ধারণার সৃষ্টি হয়। তো কুরআন মজীদের ইরশাদ- ‘বেঁচে থাক বহু ধারণা থেকে।’ সেই ‘বহু ধারণা’ কী- তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি; অনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘বহু ধারণা’ থেকে বেঁচে থাক। অর্থাৎ, ধারণার ক্ষেত্রে সতর্ক হও। ধারণাবাজী পরিহার কর। বহু ধারণা আছে যা বর্জনীয়। সুতরাং মনে যাই আসে তাই বাস্তব মনে করো না। ভিত্তিহীন ধারণা, অপ্রাসঙ্গিক ধারণা মনে আসামাত্র বাতিল করে দাও। মনে স্থান না পেলে তা ক্ষতি করতে পারে না এবং গুনাহও হয় না। কিন্তু মনে স্থান পেলে তা মুখেও আসতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে অন্যায় আচরণও হয়ে যেতে পারে। আর কে না জানে, গীবত ও মিথ্যা অপবাদ গুনাহ। কারো সাথে অন্যায় আচরণ করা গুনাহ।