মো. এ কে নোমান, নওগাঁ:বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে নওগাঁর ধামইরহাটে অনুষ্ঠিত হলো এক বর্ণিল ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন ‘মানবসেবা’-এর উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতা ১১ অক্টোবর বিকেলে রামরামপুর ফুটবল মাঠে সম্পন্ন হয়। বিশাল আয়োজনের এই প্রতিযোগিতা দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত হাজারো মানুষের ঢল নামে। নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ সবাই মিলিত হয়ে এ ঐতিহ্যবাহী খেলাকে উপভোগ করে। উৎসবমুখর পরিবেশে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতা যেমন বিনোদন প্রদান করেছে, তেমনি হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার এক মহতী প্রয়াস হিসেবে সবার প্রশংসা অর্জন করেছে।
প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মোস্তফা কামাল। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “ঘোড়দৌড়ের মতো গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ ধরনের আয়োজন শুধু বিনোদন নয়, নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যকে পরিচয় করিয়ে দেয়।”
প্রতিযোগিতায় প্রায় ৫০টি ঘোড়া অংশগ্রহণ করে। চারটি রাউন্ডে বিভক্ত এই প্রতিযোগিতা ছিল অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। প্রথম রাউন্ড থেকেই প্রতিযোগিতার মাঠে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। দেশসেরা ঘোড়সওয়ার তাসমিনার ছোট বোন হালিমা খাতুন প্রথম রাউন্ডে বিজয় ছিনিয়ে নেন, যা তাকে দর্শকদের মাঝে জনপ্রিয় করে তোলে। প্রতিটি রাউন্ডে অংশগ্রহণকারীদের দক্ষতা আর গতির প্রদর্শনী উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করে। প্রতিযোগিতার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কৌশল ও নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভর করছিল চূড়ান্ত ফলাফল, যা প্রতিযোগিতাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
মানবসেবা সংগঠনের সভাপতি রাসেল মাহমুদের সভাপতিত্বে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা বিএনপি নেতা আলহাজ্ব মো. হানজালা, সরকারি এম এম কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফরিদুজ্জামান, চকময়রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এস এম খেলাল ই রব্বানী, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আইয়ুব হোসেন এবং সাবেক ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ বেতার রাজশাহীর সংবাদ পাঠক শহিদুল ইসলাম সোহেল। এছাড়াও, উপস্থিত ছিলেন কলেজ শিক্ষক নাবিবুর রহমান, মানবসেবা সংগঠনের সদস্য সোহেল হোসেন, মাসুদ রহমান, মো. আসাদ, আনিছুর রহমান, রায়হান হোসেন এবং দাতা সদস্য কায়সার ইকবাল পণি। দোলা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী দেলোয়ার হোসেনও বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠান শেষে মানবসেবা সংগঠনের সভাপতি রাসেল মাহমুদ সংগঠনের বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “আমাদের সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে নানাবিধ সমাজসেবামূলক কাজ করে আসছে। ভিক্ষুক পুনর্বাসন, অসহায়দের জন্য গৃহনির্মাণে সহায়তা এবং দরিদ্রদের আর্থিক সহযোগিতা প্রদান আমাদের সংগঠনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। আমরা গত তিন বছর ধরে প্রতি মাসে শতাধিক ভিক্ষুককে উন্নতমানের খাবার প্রদান করে আসছি। যুব সমাজকে মাদকমুক্ত রাখতে এবং তাদের গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করতে ঘোড়দৌড়সহ নানা প্রতিযোগিতা আয়োজনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি।”
রাসেল মাহমুদ আরও বলেন, “আমরা চাই সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য এমন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে। মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে যুবকদের জন্য নিয়মিত এই ধরনের আয়োজন করা হবে।” তিনি সংগঠনের পক্ষ থেকে সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতার আহ্বান জানান।
এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা শুধু বিনোদন নয়, বরং ধামইরহাটের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অংশ হিসেবেও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। নতুন প্রজন্মকে গ্রামের পুরনো সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করা এবং ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রচেষ্টা হিসেবে এই আয়োজন বেশ সাড়া ফেলেছে। অনুষ্ঠানে আগত অতিথিরা আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান এবং আগামীতে আরও বড় পরিসরে এ ধরনের আয়োজনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এই ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার সফল সমাপ্তির মাধ্যমে ধামইরহাটবাসী যেন তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন করে মেলবন্ধন স্থাপন করতে পেরেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এই আয়োজনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে, যা স্থানীয় ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে একটি অনন্য উদ্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।