গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের প্রথম দিন যে কয়টি ক্লাবে অভিযান চালানো হয়, এর মধ্যে একটি ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব। তখন এই ক্লাবের সভাপতি ছিলেন অ্যাডভোকেট মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাওসার। তিনি ওই সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতিও ছিলেন। অবৈধ ক্যাসিনোকাণ্ডে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততার অভিযোগে মোল্লা আবু কাওসারকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতির পদ থেকে অপসারণ করা হয়। ওই ক্লাবের অন্যতম কর্ণধার এবং মোল্লা কাওসারের ‘ক্যাশিয়ার’ বলে পরিচিত কাজী শহীদুল্লাহ লিটনকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদ্য ঘোষিত কমিটিতে ৫ নম্বর সহসভাপতি হিসেবে রাখা হয়েছে। অথচ গত বছর নভেম্বরে সংগঠনটির সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে আফজালুর রহমান বাবু অঙ্গীকার করে বলেছিলেন, ‘শুদ্ধি অভিযানের ধারাবাহিকতায় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি হবে।’
কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছেন নূরে আলম সিদ্দিকী হক। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো এক অভিযোগে বলা হয়েছে, নূরে আলম সিদ্দিকী হক রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের শিকজান গ্রামের রাজাকার আমজাদ সরদারের ছেলে। আমজাদ সরদার ডাকাতি মামলায় সাত বছর জেল খেটেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, নূরে আলম সিদ্দিকী হক জেলা কৃষক লীগের সভাপতিকে হত্যার ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে স্থানীয় সংসদ সদস্য জিল্লুল হাকিম ডিও লেটার দিয়ে দলের উচ্চপর্যায়কে সতর্কও করেছিলেন। নূরে আলম সিদ্দিকী হক দুইবার দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কালুখালী উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন।
বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে ভারতে ব্যাপক আলোচনা
গত সোমবার ঘোষিত আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও কৃষক লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে কাজী শহীদুল্লাহ লিটন ও নূরে আলম সিদ্দিকী হকদের মতো আরো অনেকে বেছে বেছে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন সামনের কাতারে, তাঁদের অনেকের ঠাঁই হয়নি কমিটিতে। এসব আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কাউকে কাউকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। আবার অতীতে কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থেকেও অনেকে শুধু ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে পেয়েছেন লোভনীয় পদ। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং কৃষক লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা, স্বজনপ্রীতি এবং আর্থিক সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ এনে গতকাল মঙ্গলবার একাধিক চিঠি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হয়েছে। এসব অভিযোগের কয়েকটি কালের কণ্ঠ’র কাছে সংরক্ষিত আছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু গতকাল বলেন, ‘কোনো অভিযোগ পেলে এবং তদন্তে তা প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ অপহরণ মামলার আসামি কমিটিতে স্থান পাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘মামলা হলেও অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে দোষী বলা যাবে না।’ ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গে জড়িত এবং জামায়াত নেতার ভাইয়ের পদ পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো আমি দেখব।’
স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান অভিযোগ, রাজধানীর ক্লাবপাড়ায় অবৈধ ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গে যাঁরা জড়িত এবং রাজধানীতে টেন্ডারবাজির সঙ্গে যাঁদের সম্পৃক্ততা রয়েছে তাঁরাই গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। এ ছাড়া অপহরণ মামলার আসামি, জামায়াত নেতার ভাইকেও রাখা হয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে।
নতুন কমিটিতে সহসভাপতি হিসেবে ঠাঁই পেয়েছেন দেবাশীষ বিশ্বাস ও অ্যাডভোকেট মানিক ঘোষ। এঁদের একজনের বিরুদ্ধে রাজধানীজুড়ে টেন্ডারবাজি, অন্যজনের বিরুদ্ধে ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন মোবাশ্বের চৌধুরী। তাঁর বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি ছাড়াও ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
কৃষক লীগের কমিটির অবস্থাও একই। সংগঠনটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, কখনো নাম শোনেননি এমন দুজনকে রাখা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সহসভাপতি পদে। তাঁরা হলেন অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম হিরণ ও কৃষিবিদ ডা. নজরুল ইসলাম। আর হাইকোর্টে জুনিয়র আইনজীবী হিসেবে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃতির সঙ্গে কাজ করার পুরস্কার পেয়েছেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে আওয়ামীবিরোধী পরিবার হিসেবে পরিচিত পরিবারের সদস্য অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন লিমন। তাঁকে আইন সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়েছে। লিমনের বাবা রেলওয়ের সাবেক কর্মচারী মৃত ইসহাক মিয়া এবং শ্বশুর মাওলানা আবদুস শহীদ এলাকায় জামায়াত ঘরানার লোক হিসেবে পরিচিত। হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ ইসলামী একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবদুস শহীদ।
বঙ্গবন্ধু পেশাজীবী পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জহির উদ্দিন মবু গতকাল ফেসবুকে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে কৃষক লীগের কমিটি গঠনের ব্যাপারে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁর অভিযোগ, গত সোমবার ঘোষিত কৃষক লীগের কমিটিতে আবদুর রাশেদ খানকে পানি, সেচ ও বিদ্যুৎ বিষয়ক সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়েছে। রাশেদ খান সরাসরি জামায়াতের সঙ্গে জড়িত বলে তিনি দাবি করেন। ২০০৬ সালে গোপালগঞ্জে জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আবদুস সাত্তার ফরাজীর সঙ্গে একই মঞ্চে বসে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার তথ্য ও প্রমাণসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাজির করেন তিনি। বাংলাদেশ ডিপ্লোমা কৃষিবিদ পরিষদের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি আবদুর রাশেদ খানের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীসহ জামায়াতের একাধিক নেতার ঘনিষ্ঠতার অভিযোগও তিনি এনেছেন।
এ ছাড়া কখনো আওয়ামী লীগ বা কৃষক লীগ না করেও তথ্য এবং গবেষণা বিষয়ক সম্পাদকের পদ পেয়েছেন শামীমা সুলতানা। তিনি নড়াইলের প্রয়াত বিএনপি নেতা শরীফ খসরুজ্জামানের মেয়ে। শরীফ খসরুজ্জামান একসময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ২০০৮ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে পরাজিত হন। শামীমা সুলতানার আপন ভাই শরীফ কাসাফুজ্জামান সর্বশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পান। তবে জোটের শরিক প্রার্থীর কাছে বিএনপি আসনটি ছেড়ে দিলে শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচন করতে পারেননি।
কৃষক লীগের কমিটিতে হিজবুল বাহার রানা (সাংগঠনিক সম্পাদক) এবং রেজাউল করিম রেজার (দপ্তর সম্পাদক) পদ পাওয়া নিয়েও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। রেজা মাদক মামলার আসামি। ২০১১ সালে চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবা আনার অভিযোগে র্যাব কুমিল্লায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃতি এমপি গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, সংগঠনের সভাপতি সমীর চন্দ ও তিনি আলোচনা করে কমিটি চূড়ান্ত করেছেন। জামায়াতের সঙ্গে আবদুর রাশেদ খানের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে কি না তা তিনি জানেন না। শরীফ খসরুজ্জামানের মেয়ে শামীমা সুলতানা কখনো সংগঠন না করলেও তাঁর মেধায় তাঁরা সন্তুষ্ট হয়ে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন বলে জানান। কৃষক লীগ সাধারণ সম্পাদক দাবি করেন, আইনবিষয়ক সম্পাদক জহির উদ্দিন লিমনের পরিবার জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। এটি কিছু আইনজীবীর মিথ্যা প্রচারণা। আর দপ্তর সম্পাদক রেজাউল করিম রেজার মামলটি মিথ্যা বলে তিনি দাবি করেন।
চট্টগ্রামে অপহরণ মামলার আসামি ও জামায়াত নেতার ভাইসহ বিতর্কিতরা পেয়েছেন পদ!
চট্টগ্রাম থেকে নূপুর দেব জানান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে চট্টগ্রাম থেকে আটজন স্থান পেয়েছেন। এর মধ্যে একজন অপহরণ মামলার আসামি, একজন জামায়াত নেতার ভাইসহ চারজনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। বিতর্কিতরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পেলেও দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে থাকা অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
কেন্দ্রীয় কমিটিতে চট্টগ্রাম থেকে স্থান পাওয়া নেতারা হলেন উপদেষ্টা সদস্য সৈয়দ নুরুল ইসলাম, পাট ও বস্ত্র বিষয়ক সম্পাদক আশীষ কুমার সিংহ, উপ-পাট ও বস্ত্র বিষয়ক সম্পাদক তারেক মাহমুদ চৌধুরী পাপ্পু, সদস্য জাবেদ মাসুদ, বোখারি আজম, উপপ্রতিবন্ধী উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক ডা. উম্মে সালাম মুনমুন ও মো. আজগর আলী। এ ছাড়া কার্যনির্বাহী সদস্য হয়েছেন সাইফুল্লাহ আনসারী।
উপ-পাট ও বস্ত্র বিষয়ক সম্পাদক তারেক মাহমুদ চৌধুরী পাপ্পু সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর থানায় দায়ের করা একটি অপহরণ মামলার ২ নম্বর আসামি। গত ১৭ অক্টোবর বিকেলে সাইফুল ইসলাম নামের এক সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীকে অপহরণের অভিযোগে তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস এই মামলা করেন।
কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদস্য হওয়া জাবেদ মাসুদের পুরো নাম জাবেদুল আলম মাসুদ। তাঁর বড় ভাই জামায়াতের নেতা রাশেদুল আলম মঞ্জু। তিনি নগরীর শুলকবহর ওয়ার্ড জামায়াতের সভাপতি ও পাঁচলাইশ থানা জামায়াতের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। তিনি বর্তমানে নগরীর জামায়াতের ব্যবসায়ী সংগঠনের ওয়ার্ড শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর বিরুদ্ধে নাশকতাসহ বিভিন অপরাধে ডজনখানেক মামলা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদস্য পদ পাওয়া বোখারি আজম ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী কোনো সংগঠনের কমিটিতে কোনো পদে ছিলেন না বলে স্থানীয় নেতারা জানান। তাঁর শ্বশুর নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আবদুল মাবুদ।
সদস্য পদে স্থান পাওয়া মো. আজগর আলী সৌদি আরবপ্রবাসী। তিনি মদিনা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন।
অন্যদিকে কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে চট্টগ্রামের পাঁচ নেতা স্থান পেয়েছেন। এর মধ্যে একজন সহসভাপতি, দুজন সম্পাদকমণ্ডলীতে এবং দুজন সদস্য। চট্টগ্রামের তিন সাংগঠনিক কমিটির মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ জেলা থেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে পদ পেলেও নগর কমিটির কেউ পাননি। এ নিয়ে হতাশ চট্টগ্রাম নগরীর নেতারা।
কালের কণ্ঠ