বাংলাদেশে জোট রাজনীতির হিসাব
আস্থা ডেস্কঃ
বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক তৎপরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। একদিকে ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের সমমনা দলগুলো নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো নির্বাচন সামনে রেখে আরও জোরালো আন্দোলন শুরু করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সামনের বছর জানুয়ারি মাস নাগাদ বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর হলেও বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে। নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক জোটগুলোর হিসাব-নিকাশও এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জোটের রাজনীতির সূচনা হয়েছিল ১৯৮০ সালের গোঁড়ার দিকে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনটি রাজনৈতিক দল একত্রে জোট করে আন্দোলন করেছিল। এরপর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে বিএনপি আর ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ।
কিন্তু জোট রাজনীতির সবচেয়ে বড় প্রভাব দেখা গিয়েছিল ২০০১ সালের নির্বাচনে। সেই বছর জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে বিপুল আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। সেই মন্ত্রিসভায় জামায়াতের নেতারাও স্থান পেয়েছিলেন।
পরবর্তীতে বিএনপির সরকারের বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে ১৪ দলীয় জোট, পরবর্তীতে মহাজোট গঠন করে আওয়ামী লীগ। এই ব্যানারে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ যে সরকার গঠন করেছিল, তাতে জায়গা পেয়েছিল জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি এবং সাম্যবাদী দলের নেতারাও।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময়েও শরীক দলগুলোকে নিয়ে মহাজোটের ব্যানারে নির্বাচন করেছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ২০ দলীয় জোটে থাকলেও গণফোরামসহ কয়েকটি দল সঙ্গে নিয়ে নতুন রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে জোটবদ্ধভাবে অংশ নিয়েছিল বিএনপি।
এখন আবার ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে জোটের রাজনীতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। একদিকে আওয়ামী লীগ এবং তাদের শরীক দলগুলো একসঙ্গে নির্বাচন করা এবং সরকার গঠনের বিষয়ে আলোচনা করছে।
অন্যদিকে বিরোধী দলগুলো যৌথভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবী অর্জন করার ওপরে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে সরাসরি না বললেও তাদের সাথে থাকা জোটগুলোর শরীকরা ইঙ্গিত দিচ্ছে সরকার গঠনেও এসব দলের ভূমিকা থাকতে পারে।
বহুদিন অনেকটা নিষ্ক্রিয় থাকার পর এ বছরের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের তৎপরতা আবার শুরু হয়েছে। নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা, আন্তর্জাতিক চাপ, বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আবার জোটকে চাঙ্গা করে তোলার নীতি নিয়েছে দলটি। প্রায় ১৬ মাস পর গত জুলাই মাসে ১৪ দলীয় জোটের শরীকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে রয়েছে সাম্যবাদী দল, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, জাসদ (ইনু), গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ, গণআজাদী লীগ, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, বাসদ, তরিকত ফেডারেশন এবং জেপি।
‘’নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের জোটের তরফ থেকে প্রকাশ্য তৎপরতা শুরু করেছি। সেপ্টেম্বর মাসে এই তৎপরতা আরও বাড়বে। এখানে একটি বিষয় জানিয়ে রাখি, আমাদের জোটের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, বিএনপি এবং তাদের শরীকরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক না বা করুন, আমরা ১৪ দলীয় জোটের ব্যানারেই নির্বাচনে অংশ নেব।
অন্যদিকে এই সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে যাবে না জানিয়ে আন্দোলন জোরদার করার নীতি নিয়েছে বিএনপি। তারা জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন না করলেও যুগপৎ বা একই লক্ষ্যে আন্দোলন করার নীতি নিয়েছে।
বহু বছর ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে থাকলেও গত বছরের ডিসেম্বরে অনেকটা হঠাৎ করেই সেই জোট ভেঙ্গে দিয়ে এককভাবে চলার ঘোষণা দেয় বিএনপি। তবে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসাবে তারা গণতন্ত্র মঞ্চের মতো একাধিক প্লাটফর্ম বা রাজনৈতিক জোটের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।
বিশ দলীয় জোটের সেই দলগুলো মিলে ১২ দলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেয়। আলাদা হলেও তাদের কর্মসূচীগুলোও বিএনপির সাথে মিলিয়ে দেয়া হচ্ছে, যাকে বলা হচ্ছে যুগপৎ আন্দোলন। এদের মধ্যে আছে জাতীয় পার্টি (জাফর), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি,বাংলাদেশ জাতীয় দল, এনডিপি, এলডিপির (একাংশ), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি।
আলাদাভাবে যুগপৎ আন্দোলন করলেও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বিএনপি নেতাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে এবং আরও নতুন মোর্চা গঠনের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। বিএনপির সঙ্গে যেসব দল যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে, তারা জানিয়েছেন, সরাসরি আলোচনা না হলেও নির্বাচনে যাওয়া বা সরকার গঠনেও তারা একসাথে থাকবেন বলে আশা করছেন।
তবে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বিএনপির সঙ্গে মিলে তারা আলাদা আলাদাভাবে হলেও একই লক্ষ্যে আন্দোলন করছেন। সেই আন্দোলন আরও জোরদার করে তোলার জন্য ছাত্র-শ্রমিক পেশাজীবীদের নিয়ে পৃথক একটি মোর্চা গঠনের উদ্যোগও নেয়। বাংলাদেশে সামনের বছর জানুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।
বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো মিলেই এই মোর্চা গঠন করছে। সম্প্রতি এ নিয়ে একাধিক দলের মধ্যে বৈঠক হয়েছে, যার নাম সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য হতে পারে। বিশেষ করে সামরিক শাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় সর্বদলীয় ছাত্র আন্দোলনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সেরকম একটি মোর্চা গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যৌথভাবে নির্বাচন করে সরকার গঠন করলেও দলটি এখন নিবন্ধিত নয়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের মৃত্যুদণ্ড বা কারাদণ্ড হওয়ায় দলটি চাপে থাকলেও এই বছর তাদের আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা গেছে। কিন্তু প্রকাশ্যে তাদের সাথে খানিকটা দূরত্ব বজায় রাখছে বিএনপি।
বামপন্থী দলগুলোর সমন্বয়ে আগেই বাম গণতান্ত্রিক মোর্চা ছিল। এই বছরের জানুয়ারিতে নতুন একটি ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী’ বাম মোর্চা গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে ছোট ছোট দল বা নাম সর্বস্ব দলগুলোর সমন্বয়েও একাধিক জোট গঠনের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে কোন কোনটির নিবন্ধন আছে, কোনটির নেই।