সামনে ঘোর অন্ধকার-আমরা ঘুমাচ্ছি
- আপডেট সময় : ১০:০০:৫৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
- / ১০১৬ বার পড়া হয়েছে
সামনে ঘোর অন্ধকার-আমরা ঘুমাচ্ছি
স্টাফ রিপোর্টারঃ
পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার, সাথে বঙ্গোপসাগর, মিয়ানমারের রাখাইন ও চিন প্রদেশ এবং ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’—এটি বর্তমানে ভূ-রাজনৈতিক (Geopolitical) দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
এই অঞ্চলটি আগামী দিনে বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর (Global Superpowers) জন্য একটি ‘মনোনক্ষেত্র’ বা কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে (Strategic Competition Zone) পরিণত হচ্ছে, যা ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। এর পেছনে থাকা কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের বিশ্লেষণ:
এই অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্বের প্রধান কারণগুলো হলো: বঙ্গোপসাগর (Bay of Bengal)। এই সাগরটি ভারত মহাসাগরের প্রবেশদ্বার এবং বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বাণিজ্যিক নৌ-ট্রাফিক (Maritime Trade) এই পথে চলাচল করে।
চীনের মালাক্কা ডাইলেমা: চীন তার জ্বালানি সরবরাহের জন্য মালাক্কা প্রণালী (Malacca Strait)-এর ওপর अत्यधिक নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা কমাতে চীন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সিতওয়ে (Sittwe) বন্দরের মাধ্যমে তেল ও গ্যাস পাইপলাইন (Myanmar-China oil and gas pipelines) তৈরি করেছে। এই পাইপলাইনটি মালাক্কা প্রণালীকে এড়িয়ে সরাসরি চীনের ইউনান প্রদেশে পৌঁছায়।
ভারতের কৌশল: ভারত এই অঞ্চলে তার উপস্থিতি জোরদার করতে বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতা বাড়াচ্ছে এবং ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির মাধ্যমে সেভেন সিস্টার্সকে ব্যবহার করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার (Southeast Asia) সাথে সংযোগ স্থাপন করতে চাইছে।
২. চীন-ভারত-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা (The Great Power Rivalry)
চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI): চীন মিয়ানমারকে তার ‘চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর’ (CMEC)-এর অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে। তারা সিতওয়ে বন্দরের উন্নয়ন এবং মিয়ানমারে অন্যান্য অবকাঠামোতে বিশাল বিনিয়োগ করছে।
ভারতের প্রভাববলয়: ভারত তার প্রতিবেশী নীতি (Neighbourhood First Policy) এবং বিমসটেক (BIMSTEC)-এর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। ভারতের সেভেন সিস্টার্সের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো (যেমন ত্রিপুরার সাব্রুম) বাংলাদেশের সাথে সংযুক্ত করার মাধ্যমে আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল’ (Indo-Pacific Strategy): মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতে চায়। তারা বাংলাদেশকে ‘কোয়াড’ (QUAD) বা ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত অংশীদারদের সাথে অপ্রত্যক্ষভাবে যুক্ত করার চেষ্টা করছে। এই কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা কক্সবাজার, রাখাইন এবং বঙ্গোপসাগরের জলসীমাকে কেন্দ্র করে আরও তীব্র হচ্ছে।
৩. নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত (Internal Conflicts and Instability)
রাখাইন ও রোহিঙ্গা সংকট:
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সংকট এবং সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে এই অঞ্চলে চরম অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এই অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ওপর প্রত্যক্ষ চাপ সৃষ্টি করছে।
বিচ্ছিন্নতাবাদ ও উপদলীয় সংঘাত:
ভারতের সেভেন সিস্টার্স এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে উপদলীয় সংঘাত ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতি বড় শক্তিগুলোকে এই অঞ্চলে নিরাপত্তার নামে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়।
বাণিজ্যিক রুট ও চোরাচালান:
এই অঞ্চলটি মাদক, অস্ত্র ও মানব পাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুটে পরিণত হয়েছে, যা নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জকে বহুগুণ বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের অবস্থান:
বাংলাদেশ বর্তমানে এই ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর (যেমন মাতারবাড়ী), জ্বালানি টার্মিনাল এবং আঞ্চলিক করিডোরে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর কাছে এটিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
পরিশেষে বলা যায়: এই টোটাল অঞ্চলটি আগামী দিনে বিশ্ব রাজনীতির একটি মনোনক্ষেত্রে পরিণত হবে। এখানে পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক স্বার্থ, সামরিক কৌশল এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার আকাঙ্ক্ষা একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
লেখক: এ এইচ এম ফারুক
সাংবাদিক, লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।



















