বৈচিত্র্যময় এই দুনিয়ায় যে সকল উত্তম গুণাবলী মানুষকে প্রকৃত মর্যাদার আসনে সমাসীন করে, তন্মধ্যে বিনয় ও নম্রতা একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) সৃষ্টিজগতের বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ মহান ও মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি বিনয়ী, রহমদিল ও সহমর্মী চিত্তের অধিকারী। (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)।
হযরত ইবনে আমের (রা.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে লাল উটনীর উপর সওয়ার হয়ে জামরাকে (শয়তানকে) কঙ্কর মারতে দেখেছি। কিন্তু (ভিড়ের মাঝেও) কেউ কাউকে ধাক্কা মারতে দেখিনি এবং কেউ কাউকে হট, সরে যাও বলতে শুনিনি। যেমনটি অন্যান্য আমীর ও সুলতানের সময় হয়ে থাকে। তিনি এতটুকু নরম মেজাজের ছিলেন যে, তিনি গর্দভপৃষ্ঠে জীব ছাড়াই একিট চাদর বিছিয়ে সওয়ার হতেন।
কখনো নিজের পিছনে কাউকে সওয়ার করে নিতেন। তিনি রূগ্ন ব্যক্তিদেরকে রোগের সেবা-শুশ্রƒষা করতেন। জানাযার সাথে গমন করতেন। গোলাম-দাসদের দাওয়াত কবুল করতেন। ছেঁড়া কাপড়ে নিজেই তালি লাগাতেন। তারপর গৃহবাসী আপনজনদের সাথে গৃহস্থালির কাজ করতেন। যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সা.) কারোও দ্বারা কাজ সম্পাদন করানোকে পছন্দ করতেন না, এজন্য সাহাবায়ে কেরাম বিনা অনুমতিতে তাঁর কাজ করতেন না। (সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) শিশু-কিশোরদের নিকট দিয়ে গমন করার সময় তাদেরকে সালাম করতেন। (সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম : বর্ণনায় হযরত জাবীর (রা.) একদা কোনো এক ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে হাজির করা হলো। সে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কাঁপতে লাগল। তিনি তাকে অভয় ও সাত্ত্বনা দিয়ে বললেন, ভয় করো না, আমি বাদশাহ নই; বরং আমি একজন কুরাইশি মহিলার সন্তান। যিনি শুকনো গোশত ভক্ষণ করতেন। (আবু দাউদ ও নাসাঈ : বর্ণনায় হযরত আবু হোরায়রাহ (রা.)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামের সাথে এভাবে মিলে-মিশে বসতেন যে, কোনো অপরিচিত ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করা ব্যতীত চিনতে পারত না। একবার সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন : আপনি এমন কোনো স্থানে আসন গ্রহণ করুন, যেন অপরিচিত ব্যক্তিও আপনাকে চিনে নিতে পারে। সুতরাং এই উদ্দেশ্য পরিপূরণের লক্ষ্যে সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে একটি মাটির উঁচু ঢিবি বা মঞ্চ বানিয়ে দিয়েছিলেন। (আবু দাউদ ও নাসাঈ : বর্ণনায় হযরত আবু হোরায়রাহ (রা.)।
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বলেছেন : একবার আমি আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমার প্রাণ আপনার ওপর উৎসর্গ হোক। আপনি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আহার গ্রহণ করুন, এতে আপনি আরাম বোধ করবেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আহার গ্রহণের পরিবর্তে আরও ঝুকে আহার করতে লাগলেন। এমনকি তাঁর শির মোবারক মাটি স্পর্শ করার নিকটবর্তী হয়ে গেল। তারপর তিনি ইরশাদ করলেন : আমি বান্দাদের মতো আহার গ্রহণ করব। বান্দাদের মতোই বসব। (ইবনে জারীর)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবনভর কখনো গামলা বা দস্তরখানে আহার্যবস্তু রেখে আহার গ্রহণ করতেন না। (সহিহ বুখারী : বর্ণনায় হযরত আনাস (রা.)। যদি কখনো তাঁকে কোনও সাহাবি অথবা কোনও ব্যক্তি আহ্বান করতেন, তখন তিনি ‘লাব্বাইক’ অর্থাৎ আমি হাজির বলে উত্তর দিতেন। (আবু নাঈম, দালায়িলুন্নাবুয়াত : বর্ণনায় হযরত আয়েশা (রা.) এবং শামায়েলে তিরমিজি : বর্ণনায় হযরত যায়েদ বিন সাবিত (রা.)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মানুষের সাথে মজলিসে অংশগ্রহণ করতেন, তখন লোকজন যেভাবে কথা বলত, তিনিও সেভাবেই কথা বলতেন। যেমন মানুষ যদি জাগতিক কথাবার্তা শুরু করত, তখন তিনিও জাগতিক বিষয়ে কথাবার্তা বলতেন। আর যদি তারা ধর্ম অথবা আখেরাত সংক্রান্ত বিষয়ে কথাবার্তা বলত, তখন তিনিও সেই বিষয়েই বাক্যালাপ করতেন। মোটকথা মজলিসে বসেও তিনি নম্রতাসহ মানুষের অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখতেন।
আর যদি কখনো সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে কবিতা পাঠ করতেন এবং অন্ধকার যুগের কুফর ও গোমরাহীর কথা আলোচনা করে হাসতেন, তখন তিনিও তাদের সাথে শরিক হয়ে মুচকি হাসতেন। তিনি একমাত্র ‘হারাম’ বা নিষিদ্ধ বিষয়াদি ছাড়া অন্য কোনও কিছুর জন্য সাহাবায়ে কেরামকে ধমক দিতেন না। (সহিহ মুসলিম : বর্ণনায় হযরত জাবের বিন ওমর (রা.)।
উপরোল্লিখিত আলোচনার মাধ্যমে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র চরিত্রের যে সকল দিকগুলো অনুধাবন করতে পারি তা হলো, সহৃদয়তা, দয়া, ক্ষমা ও অনুকম্পা, ইহসান ও সদ্ব্যবহার, অঙ্গীকার পালন করা, আদল ও ইনসাফ, রক্তের সম্পর্ক অটুট রাখা, লজ্জা ও সম্ভ্রম, সচ্চরিত্রতা ও পবিত্রতা ইত্যাদি। এবার আসুন এই সকল বিষয়ের বিশ্লেষণের প্রতি নজর দেয়া যাক।