পাশবিক নির্যাতন ও রহস্যজনক মৃত্যুর শিকার উলফাত আরা তিন্নির পরিবার গত এক বছর ধরেই ছিল হুমকির মুখে। মেজো বোন ইফফাত আরা মুন্নি ওরফে মিন্নি- জামিরুল দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ আর কলহের শিকার হলেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী তিন্নি।
দেড় বছর আগে তিন্নির বাবা মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলী মারা যাওয়ার পর থেকে পুরুষ শূন্য হয়ে পড়ে পরিবারটি। আর এক বছর আগে জামিরুল ইসলামকে ডিভোর্স দেন মিন্নি। এরপর থেকেই শেখপাড়ায় মিন্নি, তিন্নি আর মা হালিমা বেগম থাকতেন।
পরিবারটির হাট-বাজারসহ নানা কাজ করতেন বিসিএস’র জন্যে প্রস্তুতি নেয়া তিন্নিই। বাড়ির অভিভাবকের মতো দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। কিন্তু মিন্নি স্বামীকে ডিভোর্স দেয়ার পর থেকেই তিন্নিকে হুমকি দিতে থাকে জামিরুল। স্ত্রী মিন্নিকে ফিরে পেতে এসব চাপ আসতে থাকে ছোট বোনের কাছে। কখনো পথ আটকে আবার কখনো মোবাইলে হুমকি-ধামকি দিতে জামিরুল। নানা রক্তচক্ষু দেখতে দেখতে একপর্যায়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন প্রতিবাদী ও সাহসী মেয়ে তিন্নি। তাকে-সহ পুরো পরিবারকে লাঞ্ছিত, মারধর, গুম-গায়েব করার কথা বলে আসছিল জামিরুল।
আরো পড়ুন: গৃহবধূকে ধর্ষণ বিবস্ত্র করে নির্যাতন, ভিডিও ভাইরাল
মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও রাত ৮টার দিকে বান্ধবীর বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরছিলেন তিন্নি। শেখপাড়া বাজারে পৌঁছালে পথ আটকে রেখেছিল জামিরুল। দীর্ঘ সময় ধরে দুইজনের কথা কাটাকাটি হয়েছিল। যা দেখেন হাট-বাজারের মানুষ। এখানেই থামেনি জামিরুল। ওই সময় জামিরুলসহ চারজন তিন্নির বাড়িতে আসে। তারা ঘরের দরজা-জানালা পেটাতে থাকে ও অকথ্য ভাষায় গালামন্দ করে। পরিবারটি অসহায় বোধ করলেও আরো বিপদের আশঙ্কায় পুলিশকে জানায়নি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি বাবা হারা তিন্নি-মিন্নির এতিম পরিবারটির। রাত ১০টার দিকে তিন্নিদের ঘরে ঢোকে ৮-১০ জনের একটি দল। মই বেয়ে, জানালার গ্লাস ভেঙে ঢুকে পড়ে দ্বিতল বাড়িতে। তবে এর আগেই ঘরে ঢুকে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল জামিরুল। আর পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে মিশন। নিজ কক্ষে সাবেক দুলাভাই জামিরুলকে দেখে চিৎকার দেন তিন্নি। একপর্যায়ে দুইজনের ধস্তাধস্তি হয়। রাত ১০টা থেকে আনুমানিক ১২টা পর্যন্ত নরক যন্ত্রণা ভোগ করেন তিন্নি, মিন্নি ও মা হালিমা বেগম। এরপর তিন্নি নিচতলায় নেমে মায়ের কাছে কেঁদে বলেন, ‘মা আমার ঘরে কেন বাইরের মানুষ, আমার তো সব শেষ, আমার বেঁচে থাকার মানে নেই’। এরপরই তিনি নিজ কক্ষে ফিরে যান। কিছুক্ষণ পর সিলিং ফ্যানের সঙ্গে পাওয়া যায় তিন্নির ঝুলন্ত লাশ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘটনার পরপরই তিন্নির কক্ষে গিয়ে দেখেন, হাঁটু গেড়ে অবস্থায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে লাশ। প্রশ্ন উঠেছে হাঁটু গেড়ে অবস্থায় কীভাবে আত্মহত্যা করলেন তিন্নি? কারো কারো মতে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
তিন্নির বোন মিন্নির সাবেক স্বামী জামিরুল কেন গিয়েছিল ওই বাড়িতে
তিন্নিদের তিন বোনের মধ্যে বড় বোন স্মোত আরা আঁখি ছিলেন শ্বশুরবাড়িতে। ঘটনার (১ অক্টোবর) রাতে অর্থাৎ বাড়িতে ছিলেন তিন্নি, মিন্নি আর মা হালিমা বেগম। আর মিন্নির দ্বিতীয় স্বামী রাজু আহম্মেদ। ঢাকা কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষ করা এই রাজু আহম্মেদের সঙ্গে মিন্নির বিয়ে হয় চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি। তিনি শৈলকুপা উপজেলার আনন্দনগর গ্রামের মহম্মদ আলীর ছেলে। আর গত বছরের ২ অক্টোবর মিন্নি প্রথম স্বামী জামিরুলকে ডিভোর্স দেন। ডিভোর্সের তিন মাস পর মিন্নি বিয়ে করেন রাজুকে। বিয়ের পর মাঝেমধ্যে মিন্নিদের বাড়িতে আসতেন রাজু। আর ঘটনার দিন তিনি এসেছিলেন। যা মেনে নিতে পারেনি মিন্নির সাবেক স্বামী জামিরুল।
কেন তিন্নি হলো এই দম্পতির কলহের শিকার
তিন্নি কী এই দম্পতির শিকার হলেন- এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সেদিন রাতে তিন্নিদের বাড়িতে থাকা মিন্নির বর্তমান স্বামী রাজু আহম্মেদের ভাষ্য ছিল এমন। মূলত রাজু-মিন্নিই ছিলেন জামিরুলের মূল টার্গেট। তাদের অপরহণ বা হত্যা করতে এসেছিল। তবে চিৎকার শুনে তারা অন্য কক্ষে গিয়ে দরজা দেয়ায় তিন্নিই হন পাশবিক নির্যাতন ও রহস্যজনক মৃত্যুর শিকার। তবে জামিরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
জামিরুলের ভাই নজরুল ইসলামের স্ত্রী তাসলিমা বলেন, ডিভোর্স হয়েছে কি না তা জানতেই তিন্নিদের বাড়ি গিয়েছিল জামিরুল। ধর্ষণ যদি হবে তবে কেন শুধু তিন্নি হলো, সেখানে তো মিন্নি ও তার মাও ছিলেন। জামরিুলের বৃদ্ধা মা গঞ্জেরা ও স্বজনদের দাবি মায়ার কারণেই সেদিন রাতে বাড়িতে যায়। কোনো ধরনের ধর্ষণ, পাশবিক নির্যাতন বা হত্যার ঘটনা ঘটায়নি জামিরুল।
মিন্নি কেন জামিরুলকে ডিভোর্স দিয়েছিলেন
এ বিষয়ে স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শৈলকুপার ত্রিবেণী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন মিন্নি। আর নিজের উপার্জিত টাকার বড় একটি অংশ স্বামী জামিরুলসহ তাদের যৌথ পরিবারকে দিতে হতো। এছাড়া স্কুল থেকে ফিরে বাড়ির যাবতীয় কাজ মিন্নিকেই করতে হতো। এসব নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না মিন্নি। দীর্ঘ বছর ধরে এসব নিয়ে সাংসারিক টানাপোড়েন চলতে থাকে। তবে ভিন্ন কথা জানিয়েছে জামিরুলের পরিবারের লোকজন।
জামিরুলের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী তসলিমা খাতুন বলেন, জামিরুল-মিন্নির সংসারে কোনো অশান্তি ছিল না। মিন্নিকে কোনো চাপ বা বাড়তি কাজকর্ম করতে হতো না। আর মিন্নির উপার্জনের টাকাও জামিরুলকে দিতে হতো না। যৌথ পরিবারে তারা সবাই সচ্ছল। ২০০৭ সালে মিন্নির বিয়ে হয় একই এলাকার তাদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয় মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান এই জামিরুলের সঙ্গে। জামিরুলের মা আর মিন্নির বাবা সম্পর্কে মামাতো-ফুফাতো ভাই-বোন।
কনির উদ্দিনের ছেলে জামিরুলের স্থানীয় শেখপাড়া বাজারে রয়েছে একটি ডেন্টাল ঘর। একজন দন্ত চিকিৎসক হিসেবে রয়েছে তার পরিচয়। জামিরুল-মিন্নি দম্পতির ঘরে ছয় বছরের এক কন্যাসন্তান রয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই দম্পতির ঘটে বিবাহ বিচ্ছেদ। মিন্নি নিজেই ডিভোর্স দেন জামিরুলকে। এরপর থেকে গত এক বছর ধরে মিন্নিকে ফিরে পেতে জামিরুল নানা প্রচেষ্টা চালায়। সেই চাপ পড়তে থাকে তিন্নির ওপর।
ঘটনার কয়েক মাস আগে উপায়ন্তর না পেয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ দেয় তিন্নির পরিবার। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ডিভোর্সের পরও জামিরুল যখন-তখন বাড়িতে চলে আসে। আর নানাভাবে চাপ দিতে থাকে। এমন অভিযোগে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দুই দফা জামিরুল ও তার পরিবারকে তলব করা হয়। কিন্তু তারা কোনো সালিশে যায়নি। তবে একবার জামিরুলের অনুপস্থিতিতে হাজির হয়েছিল তার মামা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম। তিনি তিন্নিদের বাড়িতেও গিয়েছিলেন বিচ্ছেদ হওয়া মিন্নি-জামিরুল দম্পতির সংসার ফের শুরুর আহ্বান নিয়ে। কিন্তু এতে মিন্নি রাজি ছিলেন না।
এদিকে, ডিভোর্স নিয়ে আর মুখ খুলছে না তিন্নির বোন ইফফাত আরা মিন্নি । এ ঘটনা নিয়ে সবশেষ মিন্নির বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ডিভোর্স প্রসঙ্গ জানার চেয়ে আগে তাদের কাছে জানতে চান কেন বাড়িতে ঢুকল। কেন নির্যাতন করল, কেন তার বোনের মৃত্যু ঘটল? কেন একটা মেয়ে তার স্বামীকে ডিভোর্স দেয় জানেন না, এমন নানা পাল্টা প্রশ্ন করতে থাকেন। তিনি সাংবাদিকদের বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন।
মিন্নির সাবেক স্বামী জামিরুলরা চার ভাই। তার বড় ভাই আমিরুল এলাকায় মাদকাসক্ত ও উশৃঙ্খল হিসেবে পরিচতি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। আমিরুলের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্রসহ একাধিক মামলা রয়েছে। স্থানীয়দের মতে, তাদের দাপট আর প্রভাবের মুখে এসব হুমকি-ধামকির বিচার করতে এগিয়ে আসেননি কেউ। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ আলীর বিধবা স্ত্রী ও তার দুই মেয়ে স্বস্তিতে ছিলেন না।
মিন্নির মা হালিমা বেগম বলেন, মেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় বলে বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়নি। রাস্তা-ঘাটে চলতে হয়, চাপ বাড়তে পারে তাই কোনো কথা বা অভিযোগ দেয়া হয়নি।
সবার চোখ এখন যেদিকে
উলফাত আরা তিন্নির মৃত্যুর পর কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। তবে ১ অক্টোবর রাতের এ ঘটনার পর এখন পর্যন্ত ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসেনি পুলিশের হাতে। ফলে সবার চোখ রয়েছে এদিকে। এ ঘটনার পর শৈলকুপা থানায় জামিরুল ও তার চার ভাই, তাদের স্বজনসহ আটজনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন তিন্নির মা হালিমা বেগম। এ মামলায় জামিরুলের ভাই নজরুল, আমিরুলসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে এখনো প্রধান আসামি জামিরুল পলাতক।