রংপুরের পীরগঞ্জের করতোয়া নদীর বিভিন্ন স্থানে মিলেমিশে ড্রেজার-স্যালো মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে দুই দলের নেতাকর্মীরা। মালিকাধীন জমিতে পুকুর বানিয়ে বালু লুটছে প্রভাবশালীরা। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে আইনের তোয়াক্কা না করে উপজেলায় প্রায় ৩০ টি স্থানে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে আরও কয়েকটি বালুর পয়েন্ট স্থাপনের প্রস্তুতি চলছে।
প্রশাসন পাড়া শিথিল থাকায় দিন দিন বালু উত্তোলন স্পট বা পয়েন্ট বেড়েই চলছে।
স্থানীয়রা বলছেন, বর্ষা পেরিয়ে শুকনো মওসুমের শুরুতে নদীর পানি কমে আসার সাথে সাথেই বালুখোকোরা সরব হয়ে উঠেছে। ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা, নিয়মিত মামলা, মেশিন জব্দ বালুবোঝাই গাড়ি আটক করার পর কিছুদিন বন্ধ থাকলেও ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে বালু খেকো চক্র। ব্যাঙের ছাতার মত মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে নদী থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা ও কর্মীরা। মামলা কামাল এবং জরিমানা কেও তোয়াক্কা করছেনা। বালু উত্তোলনের ফলে রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি, স্কুল কলেজ ছাড়াও ধুলাবালির কারনে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও রয়েছে।
বালু বহনকারী গাড়ি দুর্বার গতিতে চলাচলে রাস্তাঘাটে ধুলাবালি বাতাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। এতে শিশুসহ স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী, পথচারির নাকে-মুখে বালু কণা প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট বা এজমা, সর্দি-কাশি জর্নিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে।প্রতিনিয়ত প্রশাসনের নাকের ডগার উপর দিয়ে যাতায়াত করছে শত শত বালু বাহী গাড়ি।
বেশ কিছু বালু পয়েন্ট রয়েছে যেখানে আজও প্রশাসনের লোকজনের পা পড়েনি। অনেকেই বালুর ব্যবসা চলমান রাখতে তদবিরের উপর নির্ভর করছে বারোমাস। কোন কোন বালুর পয়েন্ট প্রশাসন গুড়িয়ে দিয়ে জরিমানা করলেও কয়েক দিনের মাথায় আবার চালু হয়েছে। রাস্তাঘাটের বেহালদশায় খানাখন্দে হয়রানি ও কষ্টে স্যান্ডেল বা জুতা খুলে যাতায়াত করতে হচ্ছে। বালু কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে কেউ এগিয়ে আসছে না কথাগুলো বলেছেন করতোয়া নদী এলাকার বাসিন্দারা।সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে খালাশপীর হাট। দক্ষিণে ২ কিলোমিটার প্রত্যন্ত পল্লীর বাঁশপুকুরিয়া। সেখানে করতোয়া নদীর তীরে বিএনপির মাসুদ মিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদ মিয়াসহ ১৩ ব্যক্তি ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। ২ সপ্তাহ আগে এই পয়েন্ট প্রশাসন ভেঙে দিলেও আবারো চালু হয়।
সেখান থেকে ১ কিলোমিটার দক্ষিণে শালপাড়া ঘাটে ইউপি সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য হারুন অর রশিদ বালু উত্তোলন করছে। ওই স্পট ঘেঁষে বাচ্চু মিয়াসহ বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ৬ জন কর্মী মিলেমিশে বালু উত্তোলনে জড়িত।খালাশপীর থেকে ২ কিলোমিটার পতœীচড়া ইউনিয়ন পরিষদ। সেখান থেকে ২ কিলোমিটার পশ্চিম দক্ষিণে করতোয়া নদীর বানুর ঘাট। ওই স্পটে আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র বিপ্লব মিয়াসহ ১৫ জন সদস্য রয়েছে। এই স্পটে এখনও উঁকি দেয়নি প্রশাসক।ওই পয়েন্ট থেকে ১ কিলোমিটার দক্ষিণে শালকেদহ নদীর তীরে দিনাজপুর উপজেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার করতোয়া নদীর ডান তীরে মজনু মিয়াসহ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ২০ জন সদস্য বালু কারবারি। পাশেই আওয়ামী লীগ নেতা বাবলু সরকারের পয়েন্ট আরেকটি স্পট। তাকে ঘেঁষে মশফিকুর রহমানের পৃথক স্পট। রফিকুল ইসলাম এবং বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামসহ এখানে ৫ টি স্থানে শ্যালো মেশিন বসিয়ে জমি কাটাকাটি করে পুকুর খননে বালু উত্তোলন করছে। গুঞ্জন রয়েছে প্রভাবশালী স্পট মালিকরা ঘোড়াঘাট থানা পুলিশের সাথে আঁতাতে বালু উত্তোলন করছে। এখানেও কখনও প্রশাসনের পা পড়েনি।
সম্প্রতি একই এলাকার চালু হয়েছে নতুন আরেকটি স্পট। যা নিয়ন্ত্রণ করছে রামনাথপুর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ফুল মিয়াসহ ১৫ জন। খালাশপীর থেকে চতরা সড়কের কাঞ্চনবাজার থেকে পশ্চিমে ১ কিলোমিটার হোসেনপুর গ্রামে আওয়ামী লীগ কর্মী শামীম ও রাজা মিয়াসহ ১২ জন সদস্য রয়েছে। এখনও প্রশাসনের নজরে আসেনি। ৩ মাস আগে ওই স্পটের গর্তে তাবলীগ জামাতের ইন্দোনেশিয়ার এক সাথী গোসলে নামলে মৃত্যু ঘটে। এখান থেকে কোয়াটার কিলোমিটার দুরে কুলানন্দপুর ঘাট। সেখানে বিএনপি-আওয়ামী লীগের ২টি স্পটে আমিনুল ইসলামসহ ১০ জন জড়িত। দক্ষিণে আধাকিলো দুরে বিহারি পাড়া আওয়ামী লীগ কর্মী রনি ও সুজনসহ ৮ জন নিরবে বালুর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দিনাজপুর সীমানায়। ওই স্থানে পাশেই অপর পয়েন্টে বিএনপি নেতা মুরাদ হাসানসহ ৭ জন মিলে বালুর ব্যবসা। তারাও বালু বিক্রি করছে দিনাজপুর এলাকায়। কিছুদিন আগে ওই পয়েন্টে সেনাবাহিনী অভিযান করে। কিছুদিন বন্ধ থাকলেও পুণরায় বালু উত্তোলনে সরঞ্জাম দেখা গেছে।
ওয়াজেদ মিয়া সেতুর উত্তর পাশে ৩’শ গজ দূরে বিএনপি নেতা মুক্তারুল ইসলাম বহু বছর ধরে বালু উত্তোলন করছে।
ওয়াজেদ মিয়ার সেতুর পূর্ব দিকে বটপাড়ার মোড় থেকে দক্ষিণে ২ কিলোমিটার দূরে পার বোয়াল মারি নদীর তীরে আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল বালুর জমজমাট ব্যবসা করছে। তার বড় ভাই আনোয়ার মিয়াও আলাদা ভাবে বালু উত্তোলন করছে। তাদেরকে ডিঙ্গিয়ে বালু উত্তোলন করছে কিনা মিয়াসহ ৫ জন। এছাড়াও খালাশপীর-কাঁচদহ ঘাটে বালুর গাড়ে হিসেবে পরিচিত স্থানে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মন্ডলের ছোট ভাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাফিজার রহমান মানিক মন্ডল তার নিজের জমির বালু বিক্রি করে পুকুর করছেন। এতে হুমকির মুখে পড়েছে রাস্তাঘাট কৃষি ফসলি জমি এবং বাড়ি ঘর। কষ্ট হলেও প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সাহস করে না এলাকার লোকজন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকে জানান, এই পুকুর ঘেঁষে এবং পুকুরের চারদিকে শতাধিক বাড়িঘর রয়েছে তারা সকলেই আশংকায় রয়েছে। কৃষি জমি নিয়েও বিপাকে পড়েছে। কৃষি আবাদি জমির মাটি ভেঙে পুকুরে নেমে পড়ছে। সুযোগ পেয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে কমদামে তারা ওইসব জমি কিনছেন। চাপে পড়ে অনেকে কমদামে কৃষি জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খাদিজা বেগম জানান, উপজেলার অনেক এলাকার বালুর পয়েন্টে অভিযান করে ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে লাখ লাখ টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে। অভিযান চলমান রয়েছে।
এমকে/আস্থা